কাঁচা ঘরে বেশি মানুষের বসবাস

দিনাজপুর জেলার রঙ্গন গ্রামে কোরা জনগোষ্ঠীর বাড়ি। ছবি: ফিলিপ গাইন (অন দ্য মার্জিনস বই থেকে)
দিনাজপুর জেলার রঙ্গন গ্রামে কোরা জনগোষ্ঠীর বাড়ি। ছবি: ফিলিপ গাইন (অন দ্য মার্জিনস বই থেকে)

দেশের তিন–চতুর্থাংশ পরিবার কাঁচা ঘরে বসবাস করে। প্রায় ৫০ লাখ মানুষের বাড়িঘর নেই। বাড়িঘর না থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ এবং পরিকল্পনা কমিশনের ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা জরিপে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করেন, এমন গবেষকেরা বলছেন, আবাসানসংকট সবচেয়ে বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে। অন্যদিকে নগরবিদেরা বলছেন, দেশের নগরগুলোতে আবাসনসংকট যেমন তীব্রতর হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে ভাসমান মানুষের সংখ্যা।

এ বছর জুনে প্রকাশিত খানা আয় ও ব্যয় জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৭৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ পরিবার স্থায়ী কাঁচা ঘরে বসবাস করে। ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ পরিবার বাস করে পাকা ঘরে। ঝুপড়ি ও অস্থায়ী কাঁচা ঘরে বাস করে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ পরিবার।

বাংলাদেশে মোট পরিবারের (খানা) সংখ্যা ৩ কোটি ৯৩ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে ২ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার পরিবার গ্রামে এবং ১ কোটি ১০ লাখ ৭০ হাজার পরিবার শহরে বাস করে।

বাংলাদেশের মানুষের এসব ঘরের ছাদ বা চাল ও দেয়াল বা বেড়া কোন ধরনের সামগ্রী দিয়ে তৈরি, তারও তথ্য দিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। ১১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ পরিবারের ঘরে ইট বা সিমেন্টের ছাদ। এই হার গ্রামের চেয়ে শহরে পাঁচ গুণ বেশি। ৮৪ দশমিক ২৯ শতাংশ পরিবারে ঘরের চাল টিন বা কাঠের। খড়, নাড়া, বাঁশ বা অন্য কিছু দিয়ে চাল তৈরি করেছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ পরিবার।

ঘরের পরিবেশ

এসব ঘরের মধ্যে কী পরিবেশে মানুষ বাস করে, তার বর্ণনা অবশ্য পাওয়া যায় বাংলাদেশে জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে। ২০১৪ সালের জরিপ বলছে, ৬৮ শতাংশ পরিবারের ঘরের মেঝে মাটি ও বালির। গ্রামে এই হার ৮২ শতাংশ। অন্যদিকে শহরের ৬১ শতাংশ ঘরের মেঝে সিমেন্টের।

এই জরিপ বলছে, একটি পরিবারে ঘুমানোর জন্য কতটি কক্ষ আছে, তা নির্ভর করে পরিবারের সদস্যসংখ্যার ওপর। বেশি সদস্য যক্ষ্মা, হামজাতীয় সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। প্রতি তিনটির মধ্যে একটি পরিবারের ঘুমানোর কক্ষ মাত্র একটি। তবে এই হার ক্রমশ কমে আসছে। ২০০৭ সালে ৪০ শতাংশ পরিবারে ঘুমানোর কক্ষ ছিল একটি করে। ২০১১ সালে দেখা গেছে তা কমে ৩৫ শতাংশে দাঁড়ায়। আর সর্বশেষ জরিপে তা ৩৩ শতাংশ। একই জরিপে বলছে, এক থেকে দুজন ঘুমায় ৬৫ শতাংশ কক্ষে। ৭ শতাংশ কক্ষে ৫ জন বা তার বেশি মানুষ ঘুমায়।

পরিসংখ্যন ব্যুরোর বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বাড়িঘরের আয়তনের তথ্য দেওয়া হয়েছে। গড়ে বাংলাদেশের পরিবারগুলোর মেঝের আয়তন ৪৩০ বর্গফুট: শহরে ৪৭৫ ও গ্রামে ৩৯২ বর্গফুট। অন্যদিকে ঘুমানোর ঘরের গড় আয়তন ১০১ বর্গফুট: শহরে ১১৪ বর্গফুট ও গ্রামে ৯১ বর্গফুট।

গৃহহীন মানুষ

গ্রামে গৃহহীন মানুষ খুব চোখে পড়ে না। অন্যের বা আত্মীয়ের জমিতে বা নদীপাড়ের খাসজমিতে মানুষ ঘর বাঁধে। উপকূল অঞ্চলে বেড়িবাঁধের ওপরও বহু মানুষ ঘর বেঁধে বাস করে। যেসব মানুষের এসব বিকল্পের কোনোটিই নেই, তারা চলে আসে শহরে। শহরে এসেও সব মানুষ ঘরে বাস করতে পারে না।

এই ঘরে বাস করতে না পারা মানুষ বাড়ছে। ১৯৯১ সালে শহর এলাকার গৃহহীন মানুষ ছিল ৯ লাখ ৫০ হাজার। ২০০১ ও ২০১০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১১ লাখ ৩০ হাজার ও ৪৬ লাখ। এই সংখ্যা ২০২১ সালে ৮৫ লাখ হতে পারে বলে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে বলা হয়েছে।

কেন মানুষ গৃহহীন

দারিদ্র্যের সঙ্গে গৃহহীন পরিস্থিতির সম্পর্ক আছে। নদীভাঙন প্রতিবছর বহু মানুষকে গৃহহীন করছে। ১৯৭৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। এর মধ্যে একটি বড় অংশ বসতভিটা। গ্রামে অনেক পরিবারের শুধু বসতভিটাটুকুই থাকে। সেই ভিটা নদীতে হারালে দরিদ্র অনেক মানুষের পক্ষে জমি কিনে নতুন ঘর তৈরি করা সম্ভব হয় না। তারা প্রথমে আশপাশের শহরে আশ্রয় নেয়, সবচেয়ে বড় অংশ ঢাকা ও চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয়। ঢাকার বস্তির ২৫ শতাংশ মানুষ বরিশাল বিভাগের, এরা মূলত নদীভাঙা মানুষ।

গত এক দশকে নদীভাঙনে ৬৮ লাখ মানুষ ঘরবাড়িছাড়া হয়েছে বলে সুইডেনভিত্তিক রাউলওয়ালবার্গ ইনস্টিটিউট ও ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে। গবেষকেরা বলেছেন, ২০১০ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলাতেই ১৩ লাখ ৪২ হাজার মানুষ ঘরবাড়িছাড়া হয়।

আবার কিছু মানুষের আবাসন সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে। জমির অধিকার না থাকায় বা উচ্ছেদের আশঙ্কায় থাকার কারণে ভালো ঘরবাড়ি তারা তৈরি করে না বা করতে পারে না। এরা মূলত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী।

.
.

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) প্রকাশিত অন দ্য মারজিনস: ইমেজেজ অব টি ওয়ার্কার্স অ্যান্ড এথনিক কমিউনিটিজ গ্রন্থে চা–শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের আবাসনের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। দেশের ১৬০টি চা–বাগানে প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এসব শ্রমিকসহ তাঁদের মোট জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এক শ বছরের বেশি সময় তাঁরা চা–বাগান বা এর আশপাশে বাস করছেন বাগানমালিকদের বেধে দেওয়া ঘরে। এসব বসতি ‘লেবার লাইন’ নামে পরিচিত। লেবার লাইনে নিজের ইচ্ছা বা পছন্দমতো ঘর বানাতে পারেন না চা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা।

দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, রাজবংশী, কোলসহ নানা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। এদের অনেকের নিজস্ব জমিজমা নেই, অনেকে খাসজমিতে বসবাস করে। নানা উন্নয়ন প্রকল্প বা ভূমিদস্যুদের কারণে মাঝমধ্যে এদের উচ্ছেদের খবর শোনা যায়।

এসব মানুষের দুর্দশা বর্ণনা করতে গিয়ে সেডের পরিচালক ফিলিপ গাইন প্রথম আলোকে বলেন, কুর্মিদের মাত্র ১৯৮টি পরিবার আছে, জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলায়। এদের ঘরগুলো মাটিতে যেন অর্ধেক দেবে আছে। তিনি আরও বলেন, দিনাজপুর, জয়পুরহাটসহ বেশ কয়েকটি জেলায় রেলের জমিতে তুরি নামের জনগোষ্ঠী বাস করে। এদের ঘরগুলো খুবই ছোট ছোট।

তবে ঘরবাড়ি নেই, এমন জনগোষ্ঠীর কথা ভাবতেই চোখের সামনে বেদেরা চলে আসে। তবে বেদেরাও ভাসমান জীবন ছেড়ে ঘর তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে বেদেদের সংখ্যা কমবেশি পাঁচ লাখ। বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার এক জরিপে বলছে, ৬০ শতাংশ বেদে ভূমিহীন, ৩৬ শতাংশ বেদের ভিটেমাটি আছে। মুন্সিগঞ্জের তিনটি, সাভারে পাঁচটি, বরিশালে একটি এবং গাজীপুরে একটি গ্রামে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছে বেদেরা। চাঁদপুরে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে খাসজমিতেও বসতি গড়ে তুলছে তারা।

শিশির মোড়ল সাংবাদিক