খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সংগ্রহ

২০১১ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রথম আলোয় ছাপা হয় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা। সেসব নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকািশত হয় দুটি বই
২০১১ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রথম আলোয় ছাপা হয় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা। সেসব নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকািশত হয় দুটি বই

স্বাধীনতার ৪০ বছর উপলক্ষে প্রথম আলো কী করতে পারে, কী করবে—এ রকম এক আলোচনায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক প্রস্তাব দেন মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। আর তাঁদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও গ্রন্থনার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। এটা ২০১১ সালের মার্চের মাঝামাঝির কথা।

আলোচনায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, ধারাবাহিক এ প্রতিবেদনের শিরোনাম হবে ‘তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না’। আর প্রতিদিন একজন খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব সম্পর্কে প্রতিবেদন ছাপা হবে। প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশের তারিখ নির্ধারিত হয় ২৬ মার্চ। প্রথমে একদম অখ্যাত, অর্থাৎ যাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালে, যাঁদের নাম আগে কেউ শোনেনি, তাঁদের বীরত্ব ও খেতাব পাওয়ার কথা আগে প্রকাশিত হবে।

ছোট প্রতিবেদন। কিন্তু তাতে সংক্ষেপে একসঙ্গে থাকবে অনেক তথ্য। খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের ঘটনা, ১৯৭১ সালে তাঁর অবস্থান, কীভাবে তিনি যুদ্ধে যোগ দিলেন, স্বাধীনতার পর কী করলেন, বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন ইত্যাদি তথ্য।

মুক্তিযুদ্ধকালের ঘটনা মুক্তিযোদ্ধারা কেউ লিপিবদ্ধ করে রাখেননি। বাস্তবে তা সম্ভবও ছিল না। স্বাধীনতার পরপরই মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা মুখে মুখে শোনা গেলেও সেই তথ্য সংগ্রহ করে কোনো আর্কাইভে সংরক্ষিত হয়নি। পরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক বই লেখা হলেও তাতে খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের তথ্য প্রায় ছিল না বললেই চলে। ফলে যাঁরা খেতাব পেয়েছেন, তাঁদের বীরত্ব সম্পর্কে তথ্য অনেকাংশেই ছিল অজানা।

তারপরও দায়িত্ব পেয়ে মনে হয়েছিল, কাজটা তেমন কঠিন হবে না। আমি খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা (সরকারি গেজেট) সংগ্রহ করলাম। এ কাজে আমাকে সহায়তা করেন আমাদের গবেষণা ও আর্কাইভ উপদেষ্টা মুহাম্মদ লুৎফুল হক। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বসূচক খেতাব নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। তাঁর বইটি ছিল আমার প্রাথমিক সূত্র।

সরকারি গেজেট ছিল দুটি। একটি ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বরের এবং অন্যটি ২০০৪ সালের ১১ মার্চে প্রকাশিত। প্রথম গেজেটে মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু নাম ছিল। কয়েকজন ছাড়া কারও ঠিকানা ছিল না। দ্বিতীয়টিতেও অনেকের ঠিকানা ছিল না। আবার গেজেটে সেনাবাহিনী, ইপিআর (এখন বিজিবি), নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, মুজাহিদ, পুলিশ ও গণবাহিনীর যোদ্ধাদের নাম আলাদা থাকলেও অনেক অসংগতি ছিল।

আমাকে বলা হয়েছিল সব জেলা ও অনেক উপজেলায় প্রথম আলোর প্রতিনিধি আছেন। তাঁদের মাধ্যমে খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য ও ছবি পাওয়া যাবে। আমি জেলাওয়ারি তালিকা করে আমাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে সবাইকে নাম-ঠিকানা দিই। এর মধ্যে হাতের কাছে যাঁদের সম্পর্কে তথ্য ছিল, তাঁদের নিয়ে ২৬ মার্চ থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু হয়।

মনে করেছিলাম, কয়েক দিন পর থেকে প্রতিনিধিরা তথ্য পাঠাবেন। তাঁর ভিত্তিতে প্রতিদিন একটি করে প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে। এভাবে নিয়মিত কাজটি চলতে থাকবে। কিন্তু আমার এ ধারণা ছিল ভুল। প্রতিনিধিরা জানালেন নানা সমস্যার কথা।

অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গেজেটে খেতাব পাওয়া যাঁদের ঠিকানা ছিল, তাঁদের কয়েকজনকে সেই ঠিকানায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। জীবিত মুক্তিযোদ্ধা অনেকে ঢাকায় বসবাস করতেন। শেষ পর্যন্ত অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাইকে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁরা কেউ কেউ বীরত্ব ও আত্মত্যাগের গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে স্বীকৃতির অপেক্ষা না করেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। জীবিত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ ও মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে খুঁজে বের করার কাজটা সহজ ছিল না। আরও কষ্টসাধ্য ছিল খেতাব পাওয়া শহীদ ও মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ। শহীদ ও মৃত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের কাছে তাঁরা কোথায় শহীদ হয়েছেন বা যুদ্ধ করেছেন, সে সম্পর্কে তথ্য নেই। জীবিত যাঁদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, তাঁরা অনেকে বয়স ও স্মৃতি–বিভ্রাটের কারণে যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা, সহযোদ্ধা বা দলনেতার নাম বলতে পারছেন না।

ফলে খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলি সংগ্রহ দুরূহ এবং কাজটি এগিয়ে নেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ল। প্রতিনিধিদের মাধ্যমে খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগত তথ্য ও তাঁরা কোথায় যুদ্ধ করেছেন বা শহীদ হয়েছেন, এই তথ্য পাওয়া যেত। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত তথ্য ছাড়া আর কিছু পাওয়া যেত না। তাঁদের বীরত্বের তথ্য নানাভাবে সংগ্রহ করতে হয়েছে—মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধা যাঁদের স্মৃতি তখনো ভালো ছিল, তাঁদের মাধ্যমে।

তখন পর্যন্ত যাঁরা জীবিত ছিলেন, তাঁদের সবার সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদনের জন্য তথ্য নেওয়া হয়। সবাই স্মৃতি থেকে বলেছেন। অনেকের স্মৃতি তখন ধূসর হয়ে গেলেও তাঁরা যা বলেছেন, তাতে অতিশয়োক্তি ছিল না। তাঁদের দেওয়া তথ্য কতটা গ্রহণযোগ্য, তা অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এই কাজ বা গবেষণার জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হয়।

নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ৫৪৬ জন মুক্তিযোদ্ধার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এ কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে প্রথম আলোর প্রতিনিধিসহ কয়েকজনের সহযোগিতায়। এর মধ্যে কয়েকজনের নাম না বললেই নয়। তাঁরা হলেন কর্নেল (অব.) এস আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রম, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নান, জাহিদ রহমান, আবু সাঈদ প্রমুখ। তাঁরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করার ব্যাপারে যে সহযোগিতা করেছেন, তা অতুলনীয়। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া এ কাজ করা সম্ভব হতো না।