জীবনব্যাপী রমজান

রমজান মুমিন ব্যক্তিদের জীবনে পরম প্রাপ্তি। এটি মহান আল্লাহর মহাদান। রহমত–বরকতে পরিপূর্ণ রমজান মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রজুড়ে প্রভাব বিস্তার করে আছে। রমজান ইমানের পরিপূরক, রমজান তাকওয়ার সহায়ক, রমজান বেহেশতের সওগাত।
ইসলামের প্রতিটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রমজানের সঙ্গে সম্পর্কিত; তাই রমজানের শিক্ষা জীবনঘনিষ্ঠ ও জীবনব্যাপী।
ইমান ও রমজান
ইমান হলো ইসলামের প্রাণশক্তি। ইমানের ভিত্তি হলো ওহি। ওহি তথা আসমানি কিতাবগুলো অবতীর্ণ হয়েছে রমজান মাসে। কোরআন মজিদও রমজান মাসে শবে কদরে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই রমজানের সঙ্গে ইমানের সুদৃঢ় যোগসূত্র বিদ্যমান। ইমান যেমন মানুষকে কুফর ও শিরক থেকে মুক্ত করে; তেমনি রমজান মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করে।
নামাজ ও রমজান
ইমানের পরেই হলো নামাজ। রমজান মাস হলো নামাজের মাস। যেমন: তারাবি বা প্রশান্তির বিশ্রামের নামাজ। রাত জাগরণের নামাজের পাশাপাশি রমজানে সাহরির বদৌলতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া সহজ হয়; এশার নামাজ ও ফজরের নামাজ জামাতে পড়ার সুযোগ বৃদ্ধি হয়, যাতে পূর্ণ রাত্র জাগরণের সওয়াব অর্জন হয়।
ফজরের নামাজ আগেভাগে পড়ে ঘুমানোর কারণে সকালে ইশরাক নামাজ পড়ার সুবিধা হয়। বিকেলে কর্মক্ষেত্র থেকে আগে বাড়ি ফেরার কারণে আসর নামাজ জামাতে পড়া যায়। ইফতার উপলক্ষে মাগরিবের নামাজ জামাতে পাওয়া যায়। অন্যান্য নফল নামাজও বেশি পড়া হয়।
রোজা ইসলামের অন্যতম খুঁটি। রোজা হলো রমজানের সেরা অনুষঙ্গ। রমজান যেমন ধাতুকে জ্বালিয়ে নিখাদ করে দেয়; রোজা তেমন ইমানদারের ষড় রিপুর কামনা–বাসনাকে জ্বাালিয়ে–পুড়িয়ে তাকে খাঁটি বান্দায় পরিণত করে। তাই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজার জন্য রমজান মাসকেই নির্ধারণ করেছেন।
জাকাত ও রমজান
ইসলামের পঁাচটি স্তম্ভের অন্যতম হলো জাকাত। রমজানের সঙ্গে জাকাতেরও সুনিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। জাকাত মানে যেমন পবিত্রতা, তেমনি রমজান মানে হলো আগুনে পুড়ে সোনা খাদমুক্ত বা খাঁটি করা। জাকাত মানে প্রবৃদ্ধি আর রমজানে প্রতি ইবাদতের সওয়াব আল্লাহ সত্তর গুণ বৃদ্ধি করে দেন।
ফিদইয়া ও রমজান
রমজানের মাহাত্ম্যের আরেকটি হলো ফিদইয়া। রমজানের রোজা একটি শারীরিক ইবাদত। কিন্তু অক্ষম ও দুর্বল ব্যক্তির জন্য এর কাজার পাশাপাশি ফিদইয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে; যা আর্থিক ইবাদত। এতে রোজার পরিধির ব্যাপকতা বোঝা যায়।
কাফফারা ও রমজান
রমজানের চমৎকারিত্বের অন্যতম হলো কাফফারা। রোজা শারীরিক ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও দুর্বল চিত্তের ব্যক্তি যদি রোজা ভঙ্গ করে; তার জন্য আল্লাহ তাআলা কাফফারার বিধান দিয়েছেন। যার মাধ্যমগুলো হলো দাসমুক্ত করা বা ষাটজন গরিবকে দুবেলা তৃপ্তিসহকারে খাওয়ানো অথবা একাধারে ষাটটি রোজা রাখা। যিনি ত্রিশ দিবসেবই রোজা ভাঙেন তিনি ষাট দিবস কীভাবে তা পালন করবেন? মানে আবারও ভাঙলে আবারও প্রতিটি রোজার জন্য দাসমুক্তি বা ষাটজন মিসকিন খাওয়ানো। মানে হলো দান খয়রাত সদাকাত তথা গরিবের সেবা ও সমাজের কল্যাণ রমজানের মুখ্য উদ্দেশ্য।
সদকাতুল ফিতর ও রমজান
ঈদুল ফিতরের দিন সকালবেলা ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। দাতা ও গ্রহীতার সুবিধার্থে রমজানেও প্রদান করা যায়। এ ঈদের সঙ্গে ফিতরার সম্পৃক্ততার কারণে এর নাম ঈদুল ফিতর। সদকাতুল ফিতর বা ‘ফিতরা’ হলো ঈদের আনন্দকে সর্বজনীন করার উপায়। ধনী–গরিব সবাই যেন ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারে তাই এ ব্যবস্থা। মানুষ সামাজিক জীব, সে অন্যের আনন্দ-বেদনায় প্রভাবিত হয়। তাই এ আনন্দের দিনে পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন যদি আনন্দে শামিল হতে না পারে তবে আনন্দ পূর্ণতা পাবে না। তাই নিজের আনন্দ সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে ও ছড়িয়ে দিতে এ ব্যবস্থা। ফিতরা বা সদকাতুল ফিতর হলো রমজানে রোজা পালনের শুকরিয়াস্বরূপ। এটি রোজার অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দেয়।
ইতিকাফ ও রমজান
বছরের যেকোনো সময় ইতিকাফ করা যায়; কিন্তু রমজান মাসের শেষ দশক ইতিকাফ করা সুন্নত মুয়াক্কাদা কিফায়া। এখান থেকেও রমজানের মহিমা অনুধাবন করা যায়। দশকের কম ইতিকাফ নফল হলেও এই ইতিকাফ অন্য সময়ের চেয়ে সত্তর গুণ বেশি ফজিলতের।
জুমাতুল বিদা ও রমজান
জুমা হলো সপ্তাহের ঈদের দিন; রমজান মাসের একেকটি জুমা অন্যান্য মাসের সত্তরটি জুমার সমতুল্য। রমজান মাসের শেষ দশক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রমজানের প্রতিটি দিন তার পূর্বের দিন অপেক্ষা দিগুণ ফজিলতপূর্ণ। সুতরাং একেকটি জুমা পূর্ব জুমা হতে বেশি ফজিলতপূর্ণ। আর শেষ জুমা তো রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের পূর্ণতাদানকারী। তাই রমজানের শেষ জুমা ‘জুমাতুল বিদা’ বা বিদায়ী জুমা নামে খ্যাতি লাভ করেছে। রমজানের আগমনে মুমিনের হƒদয়ে যেমন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়; তদ্রুƒপ রমজান বিদায়লগ্নে মুমিনদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যায়। তাই সবাই বঁাধভাঙা চোখের পানি দিয়ে তাকে বিদায় জানায়। ‘আল বিদা ইয়া মাহে রমাদান আল বিদা’ বিদায় হে মাহে রমজান বিদায় তোমায়।
ঈদ ও রমজান
ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে যা বারবার ঘুরেফিরে আসে। ঈদ জীবনের এমন আনন্দঘন মুহূর্ত, যা মানুষ বারবার কামনা ও ফিরে পেতে প্রার্থনা করে। দীর্ঘ এক মাস রমজানের প্রশিক্ষণের পর এ দিন যেন সনদ প্রদানের দিন; এদিন যেন পুরস্কার বিতরণের দিন। তাই এটি ঈদের দিন। রমজানের রোজার শেষে এ ঈদ আসে বলে এর নাম ‘ঈদুল ফিতর’। রোজার ঈদ বা রোজার পরে যে ঈদের সকালে প্রথম সুন্নত মিষ্টান্নের মাধ্যমে প্রাতঃরাশ গ্রহণ করা হয় সে দিনের ঈদ। এটি আরবি হিজরি সনের দশম মাস তথা শাওয়াল মাসের প্রথম দিন। রমজানের মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘রমজানুল মোবারক’ মানে বরকতময় রমজান। শাওয়াল মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘শাউওয়ালুল মুআজ্জম’ অর্থাৎ মহিমাময় শাওয়াল। রমজানের বরকত লাভের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্ট-ক্লেশ ও আয়াসসাধ্য সাধনার পর যে মাসটি সাফল্যের বারতা নিয়ে আসবে তা অবশ্যই মহান। সে মাসের প্রথম দিনই ঈদ বা উৎসব।
রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হলো যখন সে ইফতার করে; দ্বিতীয়টি হবে যখন সে তার মাবুদ আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। (বুখারি)। রোজাদার প্রতিদিন ইফতার করে; আবার পরের দিন রোজা রাখে। এটি হলো ছোট ইফতার; কারণ এটির পর আবারও রোজা আসে। ইফতার বা ফিতর হলো রোজা পূর্ণ করার পর আহার গ্রহণ করা; রমজান মাস শেষ করে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন সকালে যখন রোজাদার মিষ্টিমুখ করে তখন সে এক বছরের জন্য প্রকৃত অর্থে ইফতার করে বা সিয়াম সাধনা সম্পূর্ণ করে আজ প্রথম সকালের আহার গ্রহণ করে; তাই এটি বড় ইফতার। সুতরাং এটি রোজাদারের জন্য পরম আনন্দের দিন।
রমজানের শিক্ষা ও বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ
রমজান এসেছিল তাকওয়ার উৎকর্ষে মুমিনকে পূর্ণতা দিতে। মাসব্যাপী রোজা, তারাবি, ইফতার, সাহরি, তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত ও ইতিকাফের মাধ্যমে আমরা যে সংযম, লোভ সংবরণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ নিয়েছি; তা বাকি এগারো মাস কাজে লাগাতে হবে। যেমন রমজানে আমরা রোজা অবস্থায় হালাল খাবারও গ্রহণ করিনি, অনুরূপ রমজানের বাইরে আমরা হারাম খাদ্য, হারাম সম্পদ, হারাম উপার্জন পরিহার করব; অবৈধ সম্ভোগ থেকে বিরত থাকব। সকল প্রকার অন্যায় অপরাধ ও হারাম কাজ থেকে দূরে থাকব; বেশি বেশি নেক আমল করার চেষ্টা করব; তবেই আমাদের রমজানের প্রশিক্ষণ যথার্থ ও সফল হয়েছে বলে মনে করা যাবে।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি