ডিসি পাহাড়ের ভোরের পাখিরা

চট্টগ্রাম ডিসি পাহাড়ে প্রতিদিন ভোরে নিয়মিত শরীরচর্চা করেন শতায়ু অঙ্গনের সদস্যরা।  সৌরভ দাশ
চট্টগ্রাম ডিসি পাহাড়ে প্রতিদিন ভোরে নিয়মিত শরীরচর্চা করেন শতায়ু অঙ্গনের সদস্যরা। সৌরভ দাশ

সকাল ৬টা। রাতের ঘোর তখনো কাটেনি। সড়কে খুব একটা যানবাহন নেই। চারদিক শান্ত ও নির্জন। কিন্তু এরই মধ্যে কোথাও মানুষের কলরব শোনা যাচ্ছে। কিছু মানুষ এই ভোরে সমবেত হয়েছেন ডিসি পাহাড়ে শতাব্দীপ্রাচীন শিরীষগাছগুলোর নিচে। এরা যেন এই শহরের ভোরের পাখি। এখানকার বিচিত্র গাছগাছালির পাশ দিয়ে তৈরি হাঁটাপথ ধরে খোশমেজাজে হেঁটে চলেছেন শত শত নারী–পুরুষ। কেউ কেউ আবার দল বেঁধে কোনো প্রশিক্ষকের দেখিয়ে দেওয়া কায়দামতো শরীরচর্চা করছেন। এ রকম দু–তিনটি দল। একেক দলের একেক রকম পোশাক। একেকটা নাম। এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো দলটির নাম ‘শতায়ু অঙ্গন’।

আশির দশকের শেষ দিকে স্বাস্থ্যসচেতন কিছু মানুষের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা ডিসি পাহাড়কেন্দ্রিক সংগঠন শতায়ু অঙ্গনের এখন ডালপালা ছড়িয়েছে। সকালের শরীরচর্চা ছাড়াও সারা বছর ধরে পিঠা উৎসব, ফল উৎসব, নববর্ষ, পান্তা–ইলিশের মতো নানা আয়োজন থাকে তাঁদের। তবে তাঁদের প্রথম ও প্রধান কাজ স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবা, কাজ করা। প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর সংগঠনের নির্দিষ্ট পোশাক পরে ডিসি পাহাড়ে চলে আসেন। এক ঘণ্টার মতো সময় নিয়ে হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম। তারপর সবাই গাছের ছায়ায় বসে নানা খোশগল্পে মেতে ওঠেন। সাংগঠনিক কথাবার্তাও সারেন। এ রকমই একদিন শরীরচর্চা শেষ করে ডিসি পাহাড়ের উন্মুক্ত মঞ্চের পাশে গল্পে মেতেছিলেন সভাপতি মনসুর আহমদ, উপদেষ্টা মোহাম্মদ রুস্তম আলী, সাধারণ সম্পাদক অমৃত লাল দে, সহসাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিম, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক পীযূষ কুমার দত্ত। চট্টগ্রাম শহরের বহু মানুষের কাছে পরিচিত এই ৩০ বছেরর পুরোনো সংগঠনটির আদ্যোপান্ত জানালেন তাঁরা।

শতায়ু অঙ্গনের সভাপতি একসময়ের ছাত্রনেতা, ব্যবসায়ী  মনসুর আহমদ বাবুল বললেন, ‘ডিসি পাহাড়ের সবুজ প্রকৃতির মধ্যে আমাদের দিন শুরু হয়। শুধু শরীরচর্চা নয়, একজন মানুষের সার্বিক কল্যাণটাই আমাদের মাথার ভেতর থাকে। তাই শরীরচর্চার পরও আমরা এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটাই, কথা বলি, পরস্পর কুশল বিনিময় করি, সুখ–দুঃখ, আনন্দ–বেদনা ভাগাভাগি করি। শরীর কখনো একা একা ভালো থাকে না, মনটাকেও সুস্থ রাখতে হয়। সার্বিক কল্যাণের বোধটা আমাদের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে রয়েছে।’

আর সেই ‘সার্বিক কল্যাণে’র তাগিদে দীর্ঘ পথচলায় সংগঠনের কার্যক্রমের বিস্তারও ঘটেছে। শতায়ু অঙ্গন বছরে একবার অন্তত পুনর্মিলনীর আয়োজন করে। আয়োজন করে পিঠা উৎসব, ফল উৎসব, নববর্ষ উদ্‌যাপন, পান্তা–ইলিশ ভোজ উৎসবের। এর পাশাপাশি প্রতিটি জাতীয় দিবস পালন করে শতায়ু অঙ্গন। শুধু কি উৎসব? সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সংগঠনের যাঁরা সদস্য, তাঁদের সন্তানসন্ততির জন্য বৃত্তি, অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা, বিয়েশাদি ইত্যাদি সামাজিক কাজেও সাহায্য করে এ সংগঠন।

>১৯৯০ সালে শরীরচর্চা সংগঠন শতায়ু অঙ্গন যাত্রা শুরু করে। এখন চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘি, কর্ণফুলী, কাট্টলী, স্টিল মিলবাজারসহ কয়েকটি জায়গায় শতায়ু অঙ্গন গড়ে উঠেছে।

 আশির দশকের শেষের দিকে সেই সময়কার কিছু তরুণ প্রতিদিন ভোরে ডিসি পাহাড়ে হাঁটতে আসতেন। এখানেই আলাপ–পরিচয়। একে অন্যের ভালোমন্দের খবর নিতেন। দেখা, পরিচয়, পরে বন্ধু হয়ে যাওয়া মানুষগুলো একসময় তাগিদ অনুভব করলেন এক হয়ে একটা কিছু করার। ব্যবসায়ী মানিক দেবনাথ, এম এন ইসলাম, আইনজীবী চন্দন দাশ, হুমায়ুন কবির, ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, শেখ জহিরুদ্দিন, ব্যাংকার জাকির হোসেন, নীলুফার রহমান কল্পনা, মাইনুদ্দিন খন্দকারসহ আরও অনেকই সেই উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারও আগে অবশ্য বাটালি হিলে ‘শতায়ু অঙ্গন: বাটালি হিল’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সেখানকার প্রাতর্ভ্রমণকারীরা। তাঁদের অনুপ্রেরণাতেই ডিসি হিলকেন্দ্রিক এই সংগঠন গড়ে ওঠে বলে জানালেন মানিক দেবনাথ। ১৯৯০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শতায়ু অঙ্গন যাত্রা শুরু করে। সেই থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এখন চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘি, কর্ণফুলী, কাট্টলী, স্টিল মিলবাজারসহ কয়েকটি জায়গায় শতায়ু অঙ্গন গড়ে উঠেছে। তবে সক্রিয় ও স্বতন্ত্র শাখাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো ডিসি পাহাড়ের সংগঠনটি।

ডিসি পাহাড়ের শতায়ু অঙ্গন এখন সাত শতাধিক সদস্যের একটি সংগঠন। প্রতিদিন ভোরে গড়ে দুই শর বেশি সদস্য ডিসি পাহাড়ে আসেন। নারীরা হাঁটেন, আর পুরুষেরা প্রশিক্ষকের মাধ্যমে ব্যায়াম করেন। একসময় তাঁদের বেতনধারী প্রশিক্ষক ছিলেন। এখন উত্তম দাশ, পীযূষ দত্ত, সুব্রত বড়ুয়া, বাবু ঘোষের মতো অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকেরা আছেন। তাঁরাই প্রতিদিন পালা করে কাজটা চালান। এসব নিয়মিত ব্যায়ামের পাশাপাশি বছরে অন্তত দুবার অভিজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ সভা করেন ডিসি পাহাড়েই। তাতে স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়া যায়। 

এতসব কর্মকাণ্ড সারা বছর ধরে কীভাবে পরিচালিত হয়, জানতে চাইলে সহসাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিম বললেন, ‘প্রতি তিন বছর পরপর সদস্যদের সরাসরি ভোটে কর্মকর্তা নির্বাচিত হন। এখানে সদস্য হতে তেমন যোগ্যতা লাগে না। উদার মনের, কুসংস্কারমুক্ত, সচেতন যেকোনো মানুষ সদস্য হতে চাইলে আমরা তাঁকে নির্ধারিত ফরম দিই। এই ফরমের দাম ধরা হয় ৫০০ টাকা। তবে দুজন পুরোনো সদস্যকে তাঁর জন্য শনাক্তকারী হতে হয়।’ তিনি জানালেন, শতায়ু অঙ্গন নিজের অনুষ্ঠানগুলোর জন্য বাইরে থেকে কোনো সাহায্য নেয় না। সংগঠনের সচ্ছল সদস্যরা সবাই মিলে অনুষ্ঠানগুলোর ব্যয়ভার বহন করেন। অবশ্য সব সদস্যকে বছরে ৩০০ টাকা দিয়ে সদস্যপদ নবায়ন করতে হয়।  

কথা বলেছিলাম সাধারণ সম্পাদক অমৃতলাল দের সঙ্গে। জানতে চাইলাম, ডিসি পাহাড়ে প্রতিদিন দিনের শুরুতে হাজারো মানুষের মেলা বসে। সবাই শতায়ু অঙ্গনের সদস্য নন। কেউ কেউ তো একা আসেন। আপনারা কেন সংঘবদ্ধ হলেন?  অমৃতলাল বললেন, ‘ভাই ভালো লাগে, এখানে প্রতিটি সদস্যের মধ্যে একটা নিবিড় ভ্রাতৃত্ববোধ রয়েছে। শতায়ু অঙ্গন শুধুই একটা প্রতীকী নাম। মানুষ শত শত বছর বাঁচে না। কিন্তু তাঁদের কীর্তি থাকে। 

এখানে আমরা নানা ধর্ম–বর্ণ শ্রেণি–পেশার মানুষ প্রতিদিন সকালে মিলিত হই কোনো স্বার্থবুদ্ধি ছাড়া। এর চেয়ে ভালো প্ল্যাটফর্ম আমরা কোথায় পাব। আজ ডিসি হিল ছাড়িয়ে নগরের বিভিন্ন প্রান্তে সচেতন মানুষেরা শতায়ু অঙ্গনের শাখা খুলেছে একই চেতনায়। আমাদের একজন সদস্য ছিলেন, নাম গোমেজ। তিনি একদিন শিরীষগাছে হেলান দিয়ে কথায় কথায় বলেছিলেন, “আমি মারা গেলে শেষযাত্রার আমার পরনে যেন শতায়ু অঙ্গনের টি–শার্টটা থাকে।” কী আশ্চর্য, এক সপ্তাহ পরেই তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন। আমরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তাঁর পরনে কোট–টাই। আর ভেতরে শতায়ু অঙ্গনের সেই টি–শার্ট।’ 

 শতায়ু অঙ্গনের সদস্যরা নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। জগৎসংসারের নানা ঝামেলার মধ্যে সবাইকে থাকতে হয়। কিন্তু ডিসি পাহাড়ে সকালবেলার সেই প্রশান্তির সময়টুকু তাদের মনকে যেন সজীব রাখে সারা দিন।