ঢাকাই রান্নার বিশ্বজয়

ডানে জর্ডানের যুবরাজ, মাঝে ফখরুদ্দিন বাবুর্চির ছেলে হাজি মোহাম্মদ রফিক, হাজি মোহাম্মদ রফিক
ডানে জর্ডানের যুবরাজ, মাঝে ফখরুদ্দিন বাবুর্চির ছেলে হাজি মোহাম্মদ রফিক, হাজি মোহাম্মদ রফিক

পরম তৃপ্তির সঙ্গে ঢাকার ফখরুদ্দিনের কাচ্চি বিরিয়ানি খাচ্ছেন জেমস বন্ড ০০৭। একটু আজব আজব লাগছে? কিন্তু ঘটনা একদম সত্যি। সেটি ঘটেছিল ১৯৯৯ সালের ১৩ মে, লন্ডনে। সেখানে ‘লে রাজ’ নামের এক রেস্তোরাঁয় ‘হেল্প এ লন্ডন চাইল্ড’ নামের একটি দাতব্য সংস্থার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল নৈশভোজ। ওতে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হয়েছিল ঢাকার ফখরুদ্দিনের কাচ্চি ও অন্যান্য খাবার। ব্রিটেনের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এন্ড্রু বেরি পাঁচ হাজার ১০০ পাউন্ডে কিনেছিলেন ফখরুদ্দিনের ডিনার টেবিল। সেখানে ব্রিটেনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে জেমস বন্ড খ্যাত অভিনেতা পিয়ার্স ব্রসনান ঢাকার কাচ্চির স্বাদ গ্রহণ করেন। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ঢাকাই খাবার নামের বইতে ঘটনাটির উল্লেখ রয়েছে।
কেতাবি কথা থাক, ফখরুদ্দিনের কাচ্চি, কাবাব, জর্দা, ফিরনিসহ শতপদের খাবার শুধু দেশের ভোজনরসিকদেরই নয়, বিদেশেও সগৌরবে বহু রথী-মহারথীর রসনা তৃপ্ত করে চলেছে। প্রায়ই তাদের রন্ধনশিল্পীদের ডাক পড়ছে লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় ভোজসভা, বিয়ে বা সামাজিক উৎসবের জন্য সুস্বাদু খাবার তৈরি করতে। আর জর্ডানের বাদশাহি মেহমানদারির খানা পাকানোর দায়িত্ব বলতে গেলে তাদের পাকাপোক্ত। বড় কোনো উৎসব উপলক্ষে ভোজসভার আয়োজন হলেই ডাক পড়ে ঢাকার ফখরুদ্দিনের রন্ধনবিশারদদের। এটি চলছে ১৯৯৭ সাল থেকে। সে বছর বাদশা হোসেনের ভাই প্রিন্স হাসান তালালের বড় মেয়ে রাহাসের বিয়ে। সেই বিয়ের ভোজে পরিবেশন করা হয়েছিল ঢাকার সব ঐতিহ্যবাহী খাবার। এই সুস্বাদু খাবারগুলো তৈরি করেছিলেন হাজি ফখরুদ্দিন বাবুর্চির তৃতীয় পুত্র হাজি মোহাম্মদ রফিক বাবুর্চি। তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক ঘটনাটি, ‘ওই বছর সেনাকুঞ্জে আমার হাতের রান্না খেয়ে খুশি হয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান সাহেব। তিনিই আমাকে জর্ডানের বাদশার পরিবারের বিয়ের ভোজের রান্নার কাজটি পাইয়ে দিয়েছিলেন।’ জর্ডানের বাদশার পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে রেহমান সোবহান রফিক বাবুর্চিকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার বাবুর্চিরাও ছিলেন পাচক নির্বাচনের প্রাথমিক পরীক্ষায়। বিচারক ছিলেন সাড়ে চার শ। পদ কাচ্চি-টিকিয়া-বোরহানি। রান্না খেয়ে সবাই লা-জওয়াব। প্রতিযোগীদের হারিয়ে রফিক বাবুর্চি পেয়ে গেলেন শাদি মোবারকের ভোজের খানা পাকানোর দায়িত্ব। আড়াই হাজার লোকের জন্য রান্না করেছিলেন তাঁরা। খাবার খেয়ে ধন্য ধন্য পড়ে গেল ঢাকার বাবুর্চিদের। খোদ বাদশা হোসেন এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন রফিক বাবুর্চিকে। সিক্ত করলেন প্রীতির চুম্বনে। নিজ হাতে পরিয়ে দিলেন হাতঘড়ি, তুলে দিলেন উপহারের বাক্স। পরের বছরও ওই দম্পতির বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এবং রানি নূরের দেওয়া এক বিশেষ ভোজসভায় ঢাকাই খাবার তৈরি করেছেন রফিক বাবুর্চি। এখনো বিশেষ আয়োজন হলে তাঁদের ডাক পড়ে। জর্ডানের বাদশাহি ভোজসভার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ঢাকাই খাবার তথা ফখরুদ্দিনের খাবারের বিশ্বপরিক্রমা।

.
.


ঢাকাই খাবারের ঐতিহ্য বহুকালের। মোগল আমলে তুর্কি, আফগান, উত্তর ভারতীয় এবং পরে আরমানি ও পর্তুগিজদের খাদ্যরীতির সংমিশ্রণে ঢাকার খাবার স্বাদে গন্ধে পরিবেশনায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লাভ করে। দীর্ঘ কালপ্রবাহে ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই খাবার ঢাকার সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। একই সঙ্গে কালপরিক্রমায় ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব প্রধানত ফখরুদ্দিন বাবুর্চির। অবশ্য তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন ১৯৯৫ সালে। তবে তাঁর নামেই তাঁর রেসিপি বিশ্বজোড়া ছড়িয়ে দিচ্ছেন যোগ্য পুত্র হাজি শফিক বাবুর্চি ও হাজি রফিক বাবুর্চি। তাঁরা দুই ভাই হাল ধরেছেন পিতার বহু শ্রম, যত্নে গড়া প্রতিষ্ঠানটির সুনাম টিকিয়ে রেখে ঢাকার খাবারের স্বাদ ও গৌরব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে। ‘ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ নামে তাঁরা গড়ে তুলেছেন চেইন শপ। ঢাকায় ভিকারুননিসা নূন স্কুলের পাশে তাঁদের আদি কেন্দ্রটি ছাড়াও মগবাজার, গুলশান-১, ধানমন্ডি, মতিঝিল, বনানী ও উত্তরায় এবং চট্টগ্রামে রয়েছে এর শাখা। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরে ২০০৬ সালে, অস্ট্রেলিয়ায় ২০০৮ সালে, দুবাইয়ে ২০১২ সালে এবং লন্ডনে খোলা হয়েছে ‘ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’-এর শাখা। হাজি মোহাম্মদ রফিক প্রথম আলোকে জানালেন, উদ্যোগ চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়াতেও শাখা খোলার।
যাঁর নাম হালে অচ্ছেদ্য হয়ে জড়িয়ে গেছে ঢাকার খাবারের ঐতিহ্যের সঙ্গে, সেই ফখরুদ্দিন সম্পর্কে দুয়েক কথা বলা আবশ্যক। তিনি ছিলেন ভারতের পাটনার দারভাঙ্গার বাসিন্দা। ভারত ভাগের পর ১৯৫৬ সালে সপরিবারে চলে আসেন চট্টগ্রামে। জীবিকার কোনো ঠিক ছিল না। অনেকটা ভাগ্যান্বেষণেই তিনি ১৯৬৫ সালে ঢাকায় আসেন। এটা-ওটা নানা কাজের পর ভিকারুননিসা নূন স্কুলে দারোয়ানের চাকরি পান পরের বছর। তখন স্কুলটিও এমন বড় ছিল না, ছাত্রীও ছিল কম। সেখানে ক্যানটিন চালানোর দায়িত্ব পান তিনি। রান্নায় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না। তবে রান্না শিখেছিলেন দিল্লির নবাব পরিবারের পাচকদের উত্তরসূরি মুসলিম মিয়ার কাছ থেকে। গুরুর তালিম আর নিজের হাতযশে দ্রুতই তাঁর রান্নার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যাঁরাই তাঁর রান্না খেয়েছেন, হাতে তাঁর জাদুর ছোঁয়া আছে বলে মেনেছেন। ক্রমে পরিণত হয়েছেন ঢাকার কিংবদন্তির বাবুর্চি হিসেবে। এখন তাঁর দুই পুত্র শফিক-রফিক ও নাতি আবদুল খালেক মিলে দেশ ও দেশের বাইরে পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁর নামটিকে, একই সঙ্গে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও।
আশীষ-উর-রহমান: সাংবাদিক।