নতুন রোগ ও পুরোনো রোগের ফিরে আসা

.
.

পৃথিবীজুড়ে নতুন নতুন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে নতুন আবির্ভাব হওয়া রোগজীবাণু ও ভাইরাস, তেমনি রয়েছে নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে পুরোনো রোগের ফিরে আসা। যেমন কোনো একটি রোগ হয়তো আগে বেশি বয়স্ক ব্যক্তিদের হতো, সেটা এখন তরুণ-যুবকদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে, প্রচলিত চিকিৎসার বিরুদ্ধে রোগটির প্রতিরোধক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে, রোগীর সংখ্যা ও রোগের বিস্তার আগের চেয়ে বেড়েছে অত্যন্ত দ্রুত। পৃথিবীতে যত মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, তার ২৬ শতাংশ এ ধরনের নতুন আবির্ভূত রোগের কারণে মারা যাচ্ছে।

মানুষ-প্রাণীর ক্রমবর্ধমান ঘনত্ব ও ঘনিষ্ঠতা, পরিবেশের প্রতিরক্ষাসক্ষমতা ক্রমবর্ধমান হারে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া প্রভৃতি কারণে প্রাণী ও প্রকৃতি থেকে নতুন নতুন রোগজীবাণু বা ভাইরাস মানবদেহে ঢুকছে। জলবায়ু পরিবর্তন ঘুমিয়ে যাওয়া জীবাণুকে জাগিয়ে দিচ্ছে, এক ঋতুর রোগ অন্য ঋতুতে নিয়ে যাচ্ছে বা ঋতুর সীমা অতিক্রম করে সারা বছরই রোগ থাকছে। মানুষের জীবনধারার পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, খাদ্য ও অন্যান্য সম্পদের অপচয়, কীটপতঙ্গবাহিত রোগ ও প্রতিরোধযোগ্য অসংক্রামক ব্যাধিরও (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরোগ ইত্যাদি) বিস্তার ঘটাচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে দেখেছেন, মানুষের মধ্যে প্রতি ১০টি সংক্রামক ব্যাধির মধ্যে ৬টির বেশি রোগ প্রাণীর কাছ থেকে ছড়াচ্ছে। আর প্রতি ৪টি নতুন সংক্রামক রোগের মধ্যে ৩টিই প্রাণীবাহিত। আমাদের জানা যেসব রোগ প্রাণীর কাছ থেকে মানুষের কাছে ছড়াচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে নিপাহ, তড়কা (অ্যানথ্রাক্স), এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, মার্স করোনা ভাইরাস, প্যানডেমিক ইনফ্লুয়েঞ্জা, জলাতঙ্ক (র‍্যাবিস), লেপ্টোস্পাইরোসিস, ইবোলা, মারবার্গ প্রভৃতি। কীটপতঙ্গবাহিত রোগের মধ্যে রয়েছে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, পীতজ্বর (ইয়েলো ফিভার), ওয়েস্ট নাইল ফিভার প্রভৃতি। বাংলাদশে এই রোগগুলোর বেশ কয়েকটি উপস্থিতি রয়েছে। পুরোনো যেসব রোগ বাংলাদেশ বা পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে একেবারেই কমে গিয়েছিল, যা আবার নতুন করে দেখা দিচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে কলেরা, ম্যালেরিয়া, প্লেগ। 

জীবাণু ও ভাইরাসবাহিত রোগ

ইনফ্লুয়েঞ্জা: ভাইরাস ও রোগজীবাণু প্রকৃতি ও মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা এবং বংশবিস্তারের জন্য বিবর্তনের নিয়মেই নিজেকে পরিবর্তিত করে। এ রকম একটি ভাইরাস হচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জা। মানুষের মধ্যে আগে থেকে এ নতুন ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে না ওঠায় মানুষ সহজেই আক্রান্ত হয়।

নিপাহ: বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, বাদুড়ের লালা-মূত্র দ্বারা দূষিত খেজুরের কাঁচা রস খেলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, পীতজ্বর: বৃষ্টি, অতিরিক্ত গরম ও আর্দ্রতা মশা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের বংশবিস্তারের জন্য খুবই অনুকূল। পৃথিবীব্যাপী নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে তাই দেখা যাচ্ছে, প্রায় সারা বছরই ডেঙ্গু থাকছে, এর বিস্তারও আগের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। ডেঙ্গু ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যেরও অদলবদল হচ্ছে, ফলে মৃত্যুর হার অনেক গুণ বেড়েছে। নতুন বৈশিষ্ট্যের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার জন্য জনস্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ থাকে সীমিত। এবার ডেঙ্গুর তাণ্ডব আমরা বাংলাদেশে দেখেছি। ২০১৭ সালে ছড়িয়ে পড়েছিল চিকুনগুনিয়া। জিকা ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা বাংলাদেশে দু-একজন রোগীর মধ্যে সীমিত থাকলেও এর বাহক এডিস মশা এ দেশে থাকায় এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কর্তৃপক্ষকে সদাসতর্ক থাকতে হচ্ছে। এডিস ইজিপ্টি মশাবাহিত আরেকটি রোগ হচ্ছে পীতজ্বর (ইয়েলো ফিভার)। বাংলাদেশে এ রোগ দেখা না গেলেও আফ্রিকায় এটির প্রাদুর্ভাব নিয়মিত ব্যাপার।

ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস: কিউলেক্স মশা দ্বারা ছড়ায় ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস। বাংলাদেশে অতিসম্প্রতি একজন রোগীর দেহে এ ভাইরাস পাওয়া গেছে। ওয়েস্ট নাইল ফিভার, ডেঙ্গু, জিকা ও পীতজ্বর ভাইরাসগুলো একই ভাইরাস গোত্রের অন্তর্গত।

ডেঙ্গু ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যেরও অদলবদল হচ্ছে, ফলে মৃত্যুর হার অনেক গুণ বেড়েছে। নতুন বৈশিষ্ট্যের ডেঙ্গু মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ কমে যায়। ছবি: প্রথম আলো
ডেঙ্গু ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যেরও অদলবদল হচ্ছে, ফলে মৃত্যুর হার অনেক গুণ বেড়েছে। নতুন বৈশিষ্ট্যের ডেঙ্গু মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ কমে যায়। ছবি: প্রথম আলো

মার্স করোনা ভাইরাস: মার্স করোনা ভাইরাস রোগটিও নিপাহর মতো বাদুড়বাহিত। রোগটি মানুষ থেকে মানুষে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে রোগটি ছড়িয়ে পড়লেও বাংলাদেশে এখনো এ রোগ নেই। কিন্তু যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের প্রচুর জনশক্তি এবং যাতায়াত রয়েছে তাই এই রোগের বিপদ থেকে আমার মুক্ত নই।

লেপ্টোস্পাইরোসিস: ইঁদুর ও অন্যান্য প্রাণী এ রোগে আক্রান্ত হয়। মানুষ আক্রান্ত হয় লেপ্টোস্পাইরোসিস রোগাক্রান্ত ইঁদুরের মূত্র দ্বারা সংক্রমিত পানির সংস্পর্শে এলে। বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ, পানিতে ডোবা কৃষিক্ষেত্রে কাজ করা মানুষ লেপ্টোস্পাইরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশেও গবেষকেরা জ্বরের রোগীদের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করে লেপ্টোস্পাইরোসিস পেয়েছেন।

চান্দিপুরা ভাইরাস: বেলেমাছি দ্বারা মানুষের দেহে এর সংক্রমণ ঘটে। সাধারণত ৯ মাস বয়সী থেকে ১৪ বছরের শিশুরা এতে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে বেলেমাছি আছে, যা দ্বারা কালাজ্বরের সংক্রমণ ঘটে।

প্লেগ: প্রতিবেশী ভারতের সুরাটে ১৯৯৪ সালে যখন অনেক দিন পর প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটল, তখন আমাদের দেশসহ গোটা পৃথিবীতে উদ্বেগ-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ২০০২ ও ২০০৪ সালে বিচ্ছিন্নভাবে প্লেগের খোঁজ পাওয়া যায়। তখন গবেষকেরা অনুসন্ধান করে দেখেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্য ইঁদুর থেকে লোকালয়ের ইঁদুরের মধ্যে প্লেগ সংক্রমিত হয়েছে, আর সেখান থেকে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।

কলেরা: বাংলাদেশ থেকে কলেরা দূর হলেও এর ভাইরাস আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রয়ে গেছে। প্রস্তুতি না থাকলে পরিবেশদূষণ, অস্বাস্থ্যকর পানি ও খাবার, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে।

ডিফথেরিয়া: বাংলাদেশে ডিফথেরিয়া এ মুহূর্তে না থাকলেও আমাদের আরেক নিকটতম প্রতিবেশী মিয়ানমারে যে তা আছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থী শিশুদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব ঘটলে। ডিফথেরিয়ায় এখন বয়স্করাও আক্রান্ত হচ্ছেন বলে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে জানা গেছে।

ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু: ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার (বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড) এর কার্যকারিতা নষ্ট করে দিচ্ছে, অতি সাধারণ রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে ওষুধ কাজ না করায় মানুষ আগের চেয়ে বেশি বেশি রোগাক্রান্ত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আগামী বিশ্ব মহামারি (প্যানেডেমিক) ঘটবে ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট মাইক্রোবস) দ্বারা। ইতিমধ্যেই ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটছে। 

আমাদের করণীয়

দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানো, জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমেই আমরা দ্রুত এসব অপ্রচলিত গুরুতর রোগব্যাধি শনাক্ত করতে পারি। আমাদের দেশে কতগুলো নির্দিষ্ট সংক্রামক রোগের নজরদারির ব্যবস্থা চালু আছে। হঠাৎ করে নতুন ও অজানা রোগের নজরদারির জন্য ঘটনাভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থাও চালু আছে। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান এর দায়িত্বপ্রাপ্ত, সেটি সিংহভাগ বৈদেশিক সহায়তানির্ভর। প্রয়োজন দেশের রাজস্ব বাজেটের ওপর ভিত্তি করে দেশের নজরদারির ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। কারণ, রোগ নজরদারির ব্যবস্থা দেশের স্বাস্থ্যনিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সারা বিশ্ব আজ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা গড়ে তুলতে কাজ করছে। আমরা কি আমাদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা শক্তিশালী করতে কাজ করব না?

দেশের জনস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা, রোগ নজরদারির ব্যবস্থা, জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সাড়াদানের ব্যবস্থা, চিকিৎসাব্যবস্থা ও ল্যাবরেটরি সক্ষমতাকে যথাযথভাবে প্রস্তুত রেখে নতুন রোগ ও নতুন করে আবির্ভাব হওয়া রোগগুলোর উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করা যায়। আর আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব, বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক রেখে এ ধরনের জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলার সুযোগ রাখতে হবে। রোগ প্রাদুর্ভাবের তথ্য গোপন রেখে দেশের ভেতরে ও বাইরে জনগণ ও উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কার্যকর সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব নয়। একটি পেশাদার ঝুঁকি সংযোগ (রিস্ক কমিউনিকেশন) সংস্কৃতি গড়ে তুলেই তা করা সম্ভব। 

ডা. মুশতাক হোসেন: (জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ববিদ। সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) (আইইডিসিআর)