পুষ্টি নিয়ে মানুষ এখন সজাগ

.
.

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে পুষ্টি খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। শুরুতেই সাম্প্রতিক সময়ের দু-একটা উদাহরণ তুলে ধরা যাক। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮ প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৩১ ভাগ খর্বকায়। ২০১৪ সালে ছিল ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে খর্বকায় শিশুর হার কমছে, যা খুবই ভালো খবর। একইভাবে কৃশকায় ও বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুর হারও কমছে। এগুলো পুষ্টি সূচকে দেশের অগ্রগতির লক্ষণ।

তবে এই অগ্রগতির ক্ষেত্রে ভৌগোলিক তারতম্য রয়েছে। অর্থাৎ দেশের সব অঞ্চলে সমানভাবে হয়নি। অপুষ্টিজনিত তিনটি সূচকের মধ্যে সিলেট বিভাগের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো নয়। যেমন বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুর হার ঢাকা ও খুলনা বিভাগে ১৯ শতাংশ, যা সিলেট বিভাগে ৩৩ শতাংশ। তবে সব বিভাগেই পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের পুষ্টিগত অবস্থা ২০১৪ সালের তুলনায় উন্নততর হয়েছে।

দেশের পুষ্টির উন্নতিতে সরকারের বিভিন্ন সময়ে নেওয়া নীতি ও পরিকল্পনা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। গবেষক, পুষ্টিবিদ, বিজ্ঞানীরা পুষ্টির উন্নতিতে কাজ করেছেন। উন্নয়নসহযোগীরা নানা উদ্যোগে সহায়তা দিয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষও এসব উদ্যোগে শামিল হয়েছে। মানুষকে পুষ্টি বিষয়ে সচেতন করতে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে সক্রিয় থাকতে দেখা 

গেছে। একটি উদ্যোগের কথা ধরা যাক। শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা রাখে মায়ের দুধ। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোর প্রচার-প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করা হয়েছে।

‘দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা ২০২৫’–এ শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো শিশুর হার ৭০ ভাগে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে এই হার ৬৫ শতাংশ। শিশুকে ঘরে তৈরি খাবার খাওয়ানোর হারও বেড়েছে। মাকে বাদ দিয়ে শিশুর পুষ্টির আলোচনা আজকের দিনে অচল। মাতৃপুষ্টি নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আলোচনা হচ্ছে, কাজ হচ্ছে। মাতৃপুষ্টি বলতে সাধারণত গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়ের পুষ্টিগত অবস্থাকে বোঝায়। গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকালে মায়ের পুষ্টিগত অবস্থা নির্ণয় করা হয়, গর্ভবতী মায়েদের ওজন বৃদ্ধি এবং দুগ্ধদানকারী মায়েদের বিএমআই (উচ্চতা অনুযায়ী ওজন) দ্বারা। কিন্তু এই পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা মাতৃপুষ্টির হার নিয়ে কোনো তথ্য ও উপাত্ত নেই। তবে একাধিক দলিল বলছে, গর্ভবতী মায়েদের প্রসবপূর্ব চারটির বেশি চেকআপ করানোর হার বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে শিশুস্বাস্থ্যের ওপর। দেশে কম জন্ম–ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুর হার কমছে।

মাকে বাদ দিয়ে শিশুর পুষ্টির আলোচনা আজকের দিনে অচল। ছবি: প্রথম আলো
মাকে বাদ দিয়ে শিশুর পুষ্টির আলোচনা আজকের দিনে অচল। ছবি: প্রথম আলো

বিজ্ঞানীরা এ কথা বলে আসছেন যে মেয়েদের কৈশোরকালীন পুষ্টি নিশ্চিত না করলে মায়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি খুব আশা করা যায় না। কৈশোরকালে দেহের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে, ফলে সার্বিক পুষ্টি চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক কিশোর-কিশোরীর সেই চাহিদা পূরণ হয় না। বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের একটি বড় অংশের ওজন ও উচ্চতা নির্ধারিত মানের চেয়ে কম। বাংলাদেশের নারীদের পুষ্টিসংশ্লিষ্ট আরও কিছু সমস্যা আছে। গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারীদের একটি অংশ রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। অন্যদিকে ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ওজনাধিক্য ও স্থূলতা বাড়ছে।

অণুপুষ্টিকণা বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাবে অপুষ্টি দেখা দেয়। দেশে অণুপুষ্টিকণার অভাবজনিত অপুষ্টি আছে। তবে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের অপুষ্টি কমে আসছে। অণুপুষ্টিকণার অভাবজনিত কারণে প্রাক্‌–বিদ্যালয়গামী ও বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে রক্তস্বল্পতা আছে। এই বয়সী শিশুদের মধ্যে আয়রনের অভাবও যথেষ্ট।

দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অপুষ্টি শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমস্যা নয়। সমাজের সব স্তরেই অপুষ্টির সমস্যা আছে। সবচেয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে স্থূলতা বেশি। আবার শহরের বস্তিতে বাস করা শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি খুব বেশি। এ কথা বেশ পুরোনো যে গুঁড়া দুধ খাওয়ানোর জন্য শিশুর অপুষ্টির ঝুঁকি বেড়ে যায়। অভিযোগ আছে, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা মাতৃদুগ্ধ বিকল্প আইন ২০১৩ মেনে চলেন না।

এ কথা সত্যি যে বাংলাদেশ পুষ্টির ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি করেছে। তবে আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। মানতে হবে যে কিছু ক্ষেত্রে এখনো বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে আছে। এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। জাতীয় পুষ্টিনীতিতে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা আছে। দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনাতে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। সম্প্রতি জাতীয় পুষ্টি পরিষদকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর উচিত নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। 

ড. এস কে রায়: (সভাপতি, বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও নিউট্রেশন ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান)