প্রথা ভাঙা এক সরকারি ডাক্তার

.
.

শাশুড়িসমাবেশে মূল বক্তা ছিলেন মো. মাহমুদুর রশিদ। মাথায় হ্যাট, গায়ে সাদার ওপর লাল রঙের কাজ করা হাফশার্ট। পেছনের ব্যানারে লেখা ছিল ‘আমার বউ আমার মেয়ে ডেলিভারি করব হাসপাতালে গিয়ে’। সমাবেশটি হয়েছিল এ বছর ২৫ সেপ্টেম্বর। স্থান মনপুরার সিতাকুন্ডু গ্রাম।
|
জনা তিরিশেক শাশুড়ি, বউ বা মা-মেয়ে ছিলেন শ্রোতা। কিশোরীদের পুষ্টিসমস্যা, অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সমস্যা, গর্ভকালীন ওজন বৃদ্ধি, প্রসবকালীন জটিলতা—এসব নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেন মাহমুদুর রশিদ। মা, শাশুড়ি ও বউয়েরা নানা প্রশ্ন করেন, চটজলদি উত্তরও তাঁরা পেয়ে যান। মাহমুদুর রশিদ অনেকটা আদেশের সুরেই সবাইকে বলেন, যেকোনো সমস্যায় তাঁরা যেন সোজা চলে যান মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

মো. মাহমুদুর রশিদ মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তাঁর মতে, কিছুটা পাগলামি হয়তো তিনি করে ফেলেছেন। তবে পাগলামি ছাড়া মনপুরার মতো জায়গায় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া ও স্বাস্থ্যের উন্নতি করা সম্ভব না।

দেশের দক্ষিণের জেলা ভোলার একটি দ্বীপ মনপুরা। এটি উপজেলা। প্রতিদিন সকালে দুটি লঞ্চ ঢাকা থেকে ভোলা হয়ে মনপুরায় আসে। বেলা তিনটার দিকে লঞ্চ দুটি চলে যায়। এক লাখ অধিবাসী নিয়ে সারা দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে মনপুরা। এখানে কোনো চিকিৎসক থাকতে চান না।

গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কেন চিকিৎসক মাহমুদুর রশিদ মনপুরায় আছেন? কেন তিনি মনপুরা বেছে নিলেন? মনপুরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কী পরিবর্তন তিনি এনেছেন? এতে মনপুরার মানুষের স্বাস্থ্যে কী উন্নতি হয়েছে? মাহমুদুর রশিদ চলে গেলে কী হবে?

ভোলারই এক উপজেলা লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করতেন মাহমুদুর রশিদ। তিনি নিজেই হাসপাতাল পরিষ্কার করতেন। তাঁর বুকে–পিঠে ঝোলানো থাকত ‘এই হাসপাতাল আপনার আমার। আসুন হাসপাতাল পরিষ্কার রাখি।’ কাজে, কথায়, চিন্তায়, এমনকি পোশাকেও অন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে তাঁর বিস্তর ফারাক।

কী ছিল কী হলো

দেশের প্রত্যন্ত এলাকা, যথা উপকূল, দ্বীপাঞ্চল বা পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ সমস্যা হচ্ছে চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীস্বল্পতা। মনপুরা তার ব্যতিক্রম নয়। ২০১৬ সালে এখানে চিকিৎসক ছিলেন দুজন। নার্স ছিলেন দুজন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন আটজন। হাসপাতালে প্রসব হয়েছিল ৪৪টি।

পরিস্থিতি পাল্টে যায় ২০১৬ সালে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদে মাহমুদুর রশিদের যোগ দেওয়ার পর। ফজরের নামাজের পর মুসল্লিদের সঙ্গে, এলাকার বয়স্কদের সঙ্গে কথা বলতেন। তাঁদের বলতেন, ‘আমি হাসপাতালের নতুন বড় ডাক্তার। রোগী নিয়ে হাসপাতালে আসবেন। আমি সারাক্ষণ হাসপাতালে থাকি।’

রোগী বেড়েছে হাসপাতালে। ২০১৮ সালে প্রসব হয়েছে ২৬৪টি। ২০১৭ সালে উপজেলায় মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ছিল ছয়টি। এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল একটি। শয্যা পূরণের হার, বহির্বিভাগে রোগী, জরুরি সেবা—সবই আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। প্রসবপূর্ববর্তী ও প্রসবপরবর্তী সেবা বেড়েছে অনেক গুণ বেশি।

বর্তমানে এখানে এখানে চিকিৎসক আছেন পাঁচজন, চারজন মিডওয়াইফসহ নার্স আছেন ১৬ জন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বেড়ে হয়েছেন ২০ জন।

কী করেছেন তিনি

মাহমুদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মানুষকে ভিন্নভাবে বার্তা দিয়েছি। আমি সাধারণ মানুষের কাছে গিয়েছি। স্বাস্থ্যসেবার কাজে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করেছি।’

দরিদ্র রোগীদের সহায়তা করার জন্য কমিউনিটি সাপোর্ট কমিটি গঠন করেন ২০১৬ সালের অক্টোবরে। এই কমিটির প্রধান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। বিভিন্ন ইউনিয়নের পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান, উপজেলার পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও স্কুল–কলেজের শিক্ষক এই কমিটির সদস্য। কমিটি একটি তহবিল গঠন করেছে।

মো. মাহমুদুর রশিদ। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
মো. মাহমুদুর রশিদ। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

মনপুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিনা আক্তার চৌধুরী বলেন, ‘ভোলা সদরে বা ঢাকায় দরিদ্র রোগী পাঠাতে এই তহবিল ব্যবহার করি। সম্প্রতি ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটও এই তহবিল থেকে করা হয়েছে। প্রতি মাসে নিয়মিত সভার পাশাপাশি মনপুরায় যেন ডেঙ্গু না ছড়াতে পারে, তার জন্য বিশেষ সভা করেছিল এই কমিটি।’

একাধিক চিকিৎসক ও নার্স প্রথম আলোকে বলেছেন, মাহমুদুর রশিদ হাসপাতালে রোগীর বিছানা যেমন ঠিক করে দেন, তেমনি গ্রামে গ্রামে রোগীদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেন।

সকালে হয়তো কোট, হ্যাট পরে হাসপাতালে ডিউটি করতে দেখা যায় এই চিকিৎসক কর্মকর্তাকে। সন্ধ্যায় হতো দেখা যায়, বাউলের পোশাকে কোনো হাটে গানের আসর জমিয়েছেন। গর্ভবর্তী মায়ের যত্ন, শিশুকে শালদুধ খাওয়ানো, শাক–সবজি বেশি খাওয়া, পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি গ্রহণ—এসবই থাকে আসরের মূল বিষয়। এসবের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মানুষের কাছে পরিচিত ও প্রিয় হয়ে উঠেছেন এই চিকিৎসক।

মনপুরা থেকে জরুরি রোগী ভোলায় বহন করার জন্য একজন নৌ কর্মকর্তার পরামর্শে নৌ অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করেছেন। নাম রাখেন ‘মেঘনা সাহস’।

মাহমুদুর রশিদের একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল চিকিৎসক ধরে রাখা যাবে কি না। এ কাজে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাঁকে বিশেষ সহায়তা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘মনপুরা ভালো জায়গা। এর চেয়ে দুর্গম এলাকা বাংলাদেশে আছে—এই কথা নতুন সহকর্মীকে বলি।’

কাজের স্বীকৃতি পাচ্ছেন মাহমুদুর রশিদ। ২০১৭ সালে সবচেয়ে সেরা কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস ক্যাটাগরিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পুরস্কার পেয়েছে মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ‘জনগণের অংশগ্রহণে দুর্গম অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা: মনপুরা মডেল’ শিরোনামে সৃজনশীল কাজের স্বীকৃতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এটুআই প্রকল্পের কর্মকর্তারা।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) শেয়ার প্রকল্প মনপুরার স্বাস্থ্য পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। গত তিন বছরে গবেষক ও বিজ্ঞানীরা তিন দফায় মনপুরা গেছেন।

সর্বশেষ তাঁরা গেছেন গত সেপ্টেম্বরে। তাঁদের সঙ্গে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকেরাও ছিলেন। তাঁদের উদ্যোগে ২৫ সেপ্টেম্বর মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ‘জনগণের জন্য স্বাস্থ্য সংলাপ’ নামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানে শেয়ার প্রকল্পের প্রধান ড. ইকবাল আনোয়ার বলেছিলে, স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে স্বাস্থ্যশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। সেই জরুরি কাজ করছেন মাহমুদুর রশিদ। সেবা পাওয়ার জন্য চিকিৎসকদেরও যথাযথ সম্মান দেওয়া জরুরি।

মো. মাহমুদুর রশিদ বলেন, ‘সমন্বিত জরুরি প্রসূতি সেবা না থাকায় অন্তঃসত্ত্বা নারীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। মনপুরার মতো দ্বীপে এই সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে দেশের অন্য কোথাও তার দরকার নেই।’

শিশির মোড়ল: (সাংবাদিক)