প্রয়োজন শিল্প খাতের মর্যাদা: শাহীন আহম্মেদ

বাংলাদেশের দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোক্তাদের সংগঠন ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) বর্তমান প্রেসিডেন্ট শাহীন আহম্মেদ এই ইন্ডাস্ট্রির নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার িনয়েছেন শেখ সাইফুর রহমান

প্রথম আলো: বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সামগ্রিক চিত্র?

শাহীন আহম্মেদ: শুরুটা হয়েছিল অনেক আগেই। ছোট ছোট করে অনেকেই কাজ শুরু করে। আস্তে আস্তে বড় হাউসও আসে। তবে ১৫ বছর আগে একটা জাগরণ আসে। তখন অনেক ফ্যাশন হাউস হয়েছে। মার্কেটের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তনও হয়েছে। এই সময়েই বিদেশি পণ্য আসছে। এটা কেবল আমাদের দেশের চিত্র, তা নয়। সব দেশেই এটা স্বাভাবিক ঘটনা। একই সময় সমান্তরালে ঢুকেছে নতুন বিনিয়োগ। তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারাও দেশীয় বাজারে এসেছে বড় বিনিয়োগ নিয়ে। এতে করে বাজারের বিস্তৃতি ঘটেছে। 

প্রথম আলো: কোন সময়কে এই ইন্ডাস্ট্রির স্বর্ণযুগ বলবেন?

শাহীন: ২০০০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সময়টাকে বলা যেতে পারে স্বর্ণযুগ। 

প্রথম আলো: সময়ের সঙ্গে বদলাতে না পারায় লোকাল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি সমস্যার মধ্যে আছে বলে মনে হয়?

শাহীন আহম্মেদ
শাহীন আহম্মেদ

শাহীন: কয়েক ধরনের উদ্যোক্তা আছে। কেউ শখের বশে এসে আবার সরে গেছে। কেউ আবার থেকেও গেছে। মাঝারি আর বড় উদ্যোক্তাদের মধ্যে পার্থক্য আছে।

তবে হ্যাঁ সময় বদলেছে। এ জন্য সময়ের সঙ্গে বদলানোর অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সেটা আমরা করতে পারিনি।

এরপরও মার্কেট স্টাডি বলছে, নানা ধরনের পোশাক সত্ত্বেও দেশীয় ফ্যাশন হাউসের পোশাকের চাহিদা যথেষ্টই রয়েছে। তবে বৈশ্বিক ফ্যাশনের প্রভাব অবশ্যই থাকবে। এর পাশাপাশি একটা কথা ঠিক, গত চার-পাঁচ বছরে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। আর সারা বিশ্বের প্রভাব অবশ্যই পড়ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ: বাড়িভাড়া ও এর অগ্রিম বৃদ্ধি, ট্যাক্স, ভ্যাট। এসবই ইন্ডাস্ট্রির অগ্রগতির অন্তরায় হয়েছে।

প্রথম আলো: ৪০ বছরেও বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি শিল্প খাত হয়ে উঠতে কেন পারেনি?

শাহীন: এত দিন আমরা নিজেরা কাজ করে যাচ্ছি, এককভাবে। একটা অ্যাসোসিয়েশন হয়েছে। কিন্তু এক হয়ে কাজ করা হয়নি। এখানে আমরা একটা অংশ দেখছি। অথচ সারা দেশে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান আছে। ঐক্যবদ্ধ হতে না পারায় শিল্প খাত হয়ে ওঠেনি। তবে পরিচিতি যথেষ্ট পেয়েছে। এই খাতে সরকার নজর দিলে আরও উন্নত হতো। 

প্রথম আলো: একটা অ্যাসোসিয়েশন করার পরও কেন ইন্ডাস্ট্রিতে উদ্যোগের অভাব থেকে যাচ্ছে? 

শাহীন: চাইলে হয়তো অনেক কিছুই সম্ভব ছিল। কিন্তু না হওয়া কারণ সম্মিলিত প্রয়াসের অভাব। আর ফ্যাশন উইক না হওয়ার কারণ আমরা সবাই নিজেদের আউটলেটে পোশাক বিক্রি করি। ফ্র্যাঞ্চাইজি নেই কিংবা রিটেইলারদের কাছে বিক্রি করি না। করলে হয়তো অনেক আগেই ফ্যাশন উইক হতো। আর সারা দেশের মানুষকে ফ্যাশন শো দেখানো সম্ভবও নয়। 

প্রথম আলো: বিশেষ কোনো উৎসব ছাড়া ফ্যাশন হাউসগুলোর কোনো কার্যক্রম থাকে না কেন? 

শাহীন: এর অন্যতম কারণ আমার মনে হয়, বড় হাউসগুলো এর প্রয়োজন অনুভব করে না। আর ছোট হাউসগুলো সব উৎসবে পোশাক করে না। তবে মিডিয়া নিজের উদ্যোগেই কিছু কাজ করে থাকে। 

বাইরের সঙ্গে আমাদের অমিল হলো, আমরা সারা বছর কাজ করি। যেটা বাইরে হয় না। 

প্রথম আলো: দেশী দশ-এর ১০ বছর পূর্তিতে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না কেন?

শাহীন: দেশী দশের প্রথম আউটলেটের রেনোভেশনের কাজ হয়েছে। পাশাপাশি ১০ নয় ১২ বছর যুগপূর্তি পালনেই আগ্রহ বেশি। তখন হয়তো বড় কিছু দেখা যাবে। 

প্রথম আলো: আপনাদের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরায় দুর্বলতা কেন?

শাহীন: এটা ঠিক নয়। আমরা বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করেছি। সরকারের বিভিন্ন মহল এখানে গ্ল্যামারকেই দেখেন। কিন্তু আমরা এই ইন্ডাস্ট্রিকে অন্যভাবে গড়ে তুলেছি। অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা না পেয়ে হতাশ হতে হয়েছে। 

প্রথম আলো: ক্রেতাদেরও কি জানাতে পারছেন আপনাদের গল্প?

শাহীন: সেই শুরুতে নিপুণকে ধরলে ধারাবাহিকভাবে সব হাউসই তাদের গল্পটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। হতে পারে, আমাদের উচ্চাভিলাষ ছিল না। বাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমরা সেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করিনি। 

প্রথম আলো: ভ্যাট ও ট্যাক্স দিচ্ছেন। অথচ সরকারের সঙ্গে দর–কষাকষির জায়গাটা তৈরি করে উঠতে পারেননি। কিন্তু কেন? 

শাহীন: এটা হয়ে ওঠেনি। আগেই বলেছি, সম্মিলিতভাবে যে কাজগুলো করতে হয়, সেটা করা হয়নি। 

প্রথম আলো: ব্যবসার সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সেটা কি সংগঠনের সদস্যদের বোঝানো হচ্ছে?

শাহীন: মার্কেটে পোশাকের চাহিদা আছে। তবে প্রতিদিনই বিভিন্নভাবে মার্কেট বদলাচ্ছে: ডিজাইন, প্যাটার্ন, কাপড়ের ধরন, দাম ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো সব বিষয়ের সমন্বয় করতে পারা। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনকে মেনে নিয়ে সেইমতোই চলতে হবে। পোশাক তৈরির জন্য ভালো কাপড়ের সংকট রয়েছে। দেশের উন্নত কাপড় পেলে সেই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

প্রথম আলো: শিল্প খাতের সরকারি স্বীকৃতি অর্জনের কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে কি না?

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো


শাহীন: এসএমই ফাউন্ডেশন আর শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আমরা অনেক দূর এগিয়েছে। বছরখানেকের মধ্যে হয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

প্রথম আলো: প্রতিনিয়ত যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তার জন্য অ্যাসোসিয়েশন কী ভূমিকা রাখছে?

শাহীন: কয়েকটা জায়গায় কাজ করার চেষ্টা করছি। যেমন আমাদের দেশের স্ট্যান্ডার্ড মেজারমেন্ট-এর একটি। এ ছাড়া এসএমই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় আমরা দক্ষতা বৃদ্ধির কাজ করছি। 

সবাইকে নিয়ে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয়টি সংগঠনকে ভাবতে হবে। অবশ্য একটা বিষয় বলতে চাই, মোট টার্নওভার কিন্তু কমেনি। বরং বেড়েছে। এটা কিন্তু ইতিবাচক দিক। তবে বাস্তবানুগ লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সুপরিকল্পনা থাকা ব্যবসার সাফল্যের পূর্বশর্ত।

প্রথম আলো: প্রেসিডেন্ট হিসেবে এফইএবি-কে আগামী ১০ বছরে কোথায় দেখতে চান?

শাহীন: প্রথম সময়ের ট্রেন্ডকে গুরুত্ব দিতে চাই। আর পোশাক নিয়ে বিদেশের বাজারে যাওয়ার চেয়ে বরং দেশের অর্ধেকের বেশি জেলায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে চাই। কারণ দেশে যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে আমাদের পোশাকের চাহিদা। 

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহীন: ধন্যবাদ আপনাকেও।