বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা কী খায়!
এ এক নতুন বাংলাদেশ। এদের আছে এক রহস্যময় কিশোর, মুস্তাফিজ। দুষ্পাঠ্য। আছেন সাব্বির, তিনি কলার উঁচু করে ব্যাটটা শূন্যে দোলাতে থাকেন। মনে হয়, ডাকছেন, আয় আয়, দে না বলটা। সৌম্য তো নিজেই একটা মারের উদ্ভাবকের স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। পেরিস্কোপ শট। আর পুরোনো তারকা তামিম, সাকিব, মুশফিক, নাসির তো আছেনই। এরই ফাঁকে বাংলাদেশ পেয়ে গেল এক বিগ-হিটারকে, গত বিশ্বকাপে দু–দুটো সেঞ্চুরি করা মাহমুদউল্লাহ। আর আছেন প্রেরণার পরশমণি—হৃদয়বান অকুতোভয় মাশরাফি। আছেন একদল গতি-তারকা, তাসকিন, আল আমিন, আবু হায়দার।
এশিয়া কাপে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে হারাল, পাকিস্তানকে হারাল এবং চলে গেল ফাইনালে। টি-টোয়েন্টির কাপে ফাইনালে বাংলাদেশ! ভাবা যায়! যে বাংলাদেশের কাছে টি-টোয়েন্টির বাংলা কু-কুড়ি!
যাবে না কেন? বাংলাদেশ কি এর আগে এক দিনের ম্যাচে বাংলাধোলাই করেনি নিউজিল্যান্ডকে, জিম্বাবুয়েকে, পাকিস্তানকে? সিরিজে হারায়নি ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে!
ক্রিকেটের এই উল্লম্ফনটা কি আকস্মিক?
বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা এভারেস্টে উঠতে শুরু করল! একটা ছেলে ওঠে তো আরেকটা মেয়ে গিয়ে উঠে পড়ে। ধানমন্ডি বয়েজ হাইস্কুলের ছাত্র জাহিদ হাসান প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে আবিষ্কার করে ফেললেন ভাইল ফারমিয়ন কণা, ৮৫ বছর ধরে যা খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা। বুয়েটের প্রাক্তণ ছাত্র ড. তাহের সাইফ মানুষের রক্তনালিতে ভাসালেন বায়োবট, যা কিনা নিউইয়র্ক টাইমস–এর মতে এই বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। বরগুনার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র দীপঙ্কর তালুকদার। তাঁর বড় ভাই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারেননি সংসারের অভাবের তাড়নায়, রাস্তায় বসে চাল-আটা বিক্রি করেছেন। সেই পরিবারের ছেলে দীপঙ্কর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে গেলেন কেমব্রিজ, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি, আইনস্টাইন ইনস্টিটিউট। পাবনার বেড়ার বিপিনবিহারী স্কুলের ছাত্র সেলিম শাহরিয়ার। ওই স্কুলের শিক্ষক পিতার হাত ধরে স্কুলে যেতেন। সেখান থেকে নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইলিনয়। এঁরা যুক্ত থাকলেন সেই বিজ্ঞানী দলে, যাঁরা তাঁদের যন্ত্রে ধরে ফেললেন অভিকর্ষ তরঙ্গ, ১৩০ কোটি বছর আগে দুই ব্ল্যাকহোলের মিলনে যা উৎপন্ন হয়েছিল। দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে, ভারতের চেয়েও বেশি। শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার কমানোতে রেকর্ড সাফল্য। শিক্ষার হার বাড়ছে, স্কুলে যাচ্ছে বেশির ভাগ শিশু।
জাতীয় জীবনে সর্বত্র যখন একটা বিজয়ের বাতাস বইছে, তখন ক্রিকেটের সাফল্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়! বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে এখন টগবগ করছে জিগীষা—জয়ের ইচ্ছা। সে যে মরুপথে বা ভেলায় চড়ে ইউরোপ পাড়ি দিতে বেরিয়ে পড়ে, সেটাও ওই মরিয়া জিগীষা থেকেই। জিততে হবে নিজের জীবনে। সেটাই জয় এনে দিচ্ছে জাতীয় জীবনেও। কৃষকেরা বিপ্লব করছেন মাঠে, শ্রমিকেরা শিল্পকারখানায়, উদ্যোক্তারা যে যেখানে পারছেন।
সাতক্ষীরার অজপাড়াগাঁর মুস্তাফিজ। বাবা চান ছেলে লেখাপড়া করুক। চারটা গৃহশিক্ষক। ছেলে তবু মাঠে ছুটে যায়। সেজ ভাই তাকে নিয়ে যায় ৪০ কিলোমিটার দূরে, সাতক্ষীরায়, ক্রিকেট অনুশীলন করতে। সেই ছেলে গোঁফের রেখা স্পষ্ট হওয়ার আগেই দাগ রেখে দেয় ক্রিকেটের বিশ্বরেকর্ড বইয়ে। ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি আছে প্রতিষ্ঠান। যেমন বিকেএসপি। কথা হচ্ছিল নারী ক্রিকেটার জেসির সঙ্গে। তিনি বললেন, বিকেএসপিতে তিনি, সাকিব আল হাসান আর এসএ গেমসে ডাবল সোনা জয়ী মাহফুজা ছিলেন বন্ধু। একটা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপিই কত খেলোয়াড় দিচ্ছে কত ইভেন্টে!
ক্রিকেটে বাংলাদেশের উত্থান তাই হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়! বাংলাদেশ হলো প্রতিভার খনি। এর আগে ক্রিকেট ধারাভাষ্যকাররা জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা কী খায়? এত বাঁহাতি স্পিনার তারা পায় কোত্থেকে! এবার তাঁরা প্রশ্ন করতে পারেন, তাদের খাদ্যতালিকায় কী যুক্ত হলো, এত পেসার তারা পাচ্ছে কোথায়?
এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে!
১৯৭১ সালে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাধা অতিক্রম করে রক্ত দিয়ে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, ৪৫ বছর পরে তারা প্রমাণ করেছে, তারা কেবল টিকে থাকতে আসেনি, তারা জিতে নিতে এসেছে।
ক্রিকেটের সাফল্যে ব্যর্থতায় কান্নাহাসির দোলায় চাপা ১৬ কোটি মানুষ কেবল নিজের জয়ের জন্য মরিয়া নয়, জাতির জয়ের জন্যও ব্যাকুল।
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত গুয়াহাটিতে ভারোত্তোলনে সোনা জয় করে ‘আমার সোনার বাংলা’র সুরে কেঁদেছেন, তাঁর সঙ্গে কেঁদেছে ৩২ কোটি চোখ। পাকিস্তানকে এশিয়া কাপে হারিয়ে অশ্রু গোপন করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা, এর যত মূল্য, সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।
বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা কী খায়? বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা আধা পেট খায় ভাত, আধা পেট খায় স্বপ্ন। পেট ভরে যদি তাদের ভাত না থাকে, তারা স্বপ্ন খায়।
লাল-সবুজের গৌরব আকাশে তুলে ধরার স্বপ্ন।
ওই স্বপ্নই বিজয়ী করছে বাংলাদেশকে। ওই স্বপ্নই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জাতিকে।