বাউলগানের 'বাহিরানা'

বাউলগান হলো সেই সাংস্কৃতিক তৎপরতার নাম, যেখানে বাউলিয়ানা ও বাঙালিয়ানা প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাঙালির আত্মপরিচয়ের এই নয়া মেনিফেস্টো রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর বাউল আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই আবিষ্কারটি পরিবেশিত হয়েছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে, যখন হিন্দু জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেগে উঠছে পূর্ববঙ্গের কৃষক চৈতন্য এবং এর প্রকাশ ঘটছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সাম্প্রদায়িক ছিল সন্দেহ নেই, হয়তো তার পেছনে ইংরেজের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসিরও উসকানি ছিল। কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে মুসলিম নিম্নবর্গের বিপুল সমর্থন ছিল। সেই দাবি অগ্রাহ্য করার উদ্দেশ্যেই প্রথমবারের মতো শিক্ষিত হিন্দু-ব্রাহ্ম সমভিব্যবহারে বাউল পরিবেশিত হলো সুধীসমাজে। একটি প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীর দাবি নাকচ করে দিতে ব্যবহূত হলো অন্য এক প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীর দর্শন ও জীবনচর্চা।
ইতিহাসের এই পরিহাসটুকু স্মরণে না রাখলে বাঙালিয়ানা ও বাউলিয়ানার এই যোগাযোগটুকুর অনুধাবন খণ্ডিত হতে বাধ্য। তবে গোড়াতে এ রকম গোলমেলে হিসাবনিকাশ থাকার পরও আদতে এই যোগাযোগটুকুই বাঙালির আত্মপরিচয়ের মৌলিক পাটাতন হয়ে উঠেছে। কত রকম সরলীকরণ থাকে জাতিগঠনের সমীকরণের মধ্যে! বাঙালিয়ানার মধ্যে বাউলিয়ানা বিলীন হওয়ার আগে বাউলগানের মধ্যে খোদ বাউল পর্যন্ত বিলীন হয়ে গেছে! অর্থাৎ বাউলগান ভিন্ন বাউলের কোনো অস্তিত্ব আজ সুধী সমাজে নেই বললেই চলে। বাউল জীবনচর্চার অন্যতর অনুষঙ্গ, যা কিনা ভদ্রলোকি রুচির সঙ্গে মানানসই ছিল না, এভাবেই গানের অনুষঙ্গে হারিয়ে গেছে।
তার মানে এই নয় যে বাউল জীবনচর্চার বাইরে বাউলগানকে আলাদা করে বোঝা বা এর রস গ্রহণ করা যাবে না। বাউলগান যে সমসাময়িক বাংলাদেশে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে টিকে আছে, তার পেছনে বাউল জীবনচর্চার অবদান হয়তো খুব বেশি নেই। লালনের পর আরও যাঁরা বাউলগানকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই জীবনচর্চায় বাউল ছিলেন না। আবার তাঁরা যে ঘটা করে নিজেদের ‘অবাউল’ দাবি করেছেন, এমনও নয়। জাতিগঠনের চক্করে বাউলগানের অছিলায় বাউলিয়ানার একটা ঢিলেঢালা চর্চা সমাজে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে এই অবধারিত ডায়ালেকটিকসকে খেয়াল না করে আমাদের উপায় নেই: একদিকে আখড়ার বাউল এবং তাদের অথেনটিসিটির অহম, অন্যদিকে হাইব্রিড বাউল এবং তাদের অভিযোজনের জখম। একদিকে সাধনা, অন্যদিকে বাজার। একদিকে তত্ত্বের আলাপ, অন্যদিকে সমাজ-অনুশীলন।
এই ডায়ালেকটিকসকে এড়িয়ে বাউলগানের বৈচিত্র্যকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারা সম্ভব নয়। দু শ বছর আগের একটা গানের ফর্ম যে সমাজে দাপটের সঙ্গে টিকে আছে, তার পেছনে বাউলিয়ানার এই বৈচিত্র্যময় অবস্থা অনেকদূর দায়ী। এ কারণেই লোকগানের বিপুল ভান্ডারের ভেতর জড়াজড়ি করে থেকেও বাউলগান আলাদা। লোকগানের ঐতিহ্যের ভেতরে সে হজম হয়ে যায়নি।
২.
এভাবেই বাউলগান বাঙালিয়ানার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পাটাতন হয়ে উঠেছে। এখন ইউনেসকোর তত্ত্বাবধানে তা দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও অংশ। ইউনেসকো ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ রকম মোট ১৯২টি সাংস্কৃতিক চর্চাকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছে, যার মধ্যে বাউলগান ছাড়াও বাংলাদেশের জামদানিশিল্প রয়েছে। ইউনেসকোর স্বীকৃতি নিশ্চয়ই খুশির সংবাদ, যদিও বাউলগানের মর্ম পুরোপুরি বুঝে তারা সেটা করেছে, এমন মনে হয় না। বুঝলে নিশ্চয়ই তারা তাদের ওয়েবসাইটে বাউলগানকে ‘বিশেষ ধরনের লোকগান’ অভিধা দিত না।
ইউনেসকোর এই স্বীকৃতিকে নানা কারণে একটু খুঁটিয়ে দেখা দরকার। বাউলগানের ছোট্ট একটা পরিচিতি তারা দিয়ে রেখেছে তাদের ওয়েবসাইটে। সেখানে তারা লিখেছে বাউলগান কোন ধরনের গানের ধারা থেকে প্রভাবিত হয়েছে ইত্যাদি। বাউলগানের দেহবাদী দর্শন নিয়েও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য আছে সেখানে। এর বাইরে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছে ইউনেসকো, যা চলতি ধারার বাউল গবেষণায় পাওয়া যায় না। তারা লিখেছে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাউলগানের কথা পাল্টে যায়, বা যুগোপযোগী হয়ে ওঠে। এই যে ক্রমাগত যুগোপযোগী হয়ে ওঠার বাসনা, এটাই কিন্তু বাউলগানের লোকপ্রিয়তার মূলমন্ত্র এবং এই চর্চার বেশির ভাগটুকুই ঘটে আখড়া বা ছেঁউড়িয়ার বাইরে। ইউনেসকো এই হাইব্রিড চর্চাকে বাউলিয়ানার বৃহত্তর পরিসরের ভেতরে বিবেচনা করেছে, এটা ভালো লক্ষণ।
কিন্তু লক্ষণ ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকে যখন আমরা বাউল সংস্কৃতির তদারকির উদ্দেশ্যে ইউনেসকো কর্তৃক গৃহীত প্রকল্পটির খোঁজ পাই। এই প্রকল্পের নাম বাউলগানের ‘সেইফগার্ডিং প্রজেক্ট’ এবং এই প্রকল্প বাউলগানকে ‘রক্ষা’ করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচির প্রস্তাব করেছে। প্রথমত, তারা কিছু কর্মশালার আয়োজন করবে, যাতে বাউল-গুরু ও শিক্ষানবিশেরা একত্র হবেন, এবং এভাবে বাউল-গুরুর গান শিষ্য পর্যন্ত পৌঁছাবে। দ্বিতীয়ত, তারা দেশজুড়ে একটা বাউলশুমারি চালাবে, যার মাধ্যমে বাউলের সঠিক সংখ্যা বের করা সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, কর্মশালায় সংগৃহীত গানগুলোর ডকুমেন্টেশন ও প্রকাশনা করা হবে এই প্রকল্প থেকে। চতুর্থত, প্রতিবছর এই প্রকল্প বাউলমেলার আয়োজন করবে, যার মাধ্যমে তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে বাউল-সচেতনতা ছড়িয়ে দেবে।
মোটামুটিভাবে, এই হলো বাউলের এনজিওকরণের ইউনেসকো প্রস্তাবিত রোডম্যাপ। এই কর্মসূচি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তারা বাউলচর্চার মধ্যে ছেঁউড়িয়ার প্রতীকী কর্তৃত্বের হিস্যা নিতে চান এবং এই আদান-প্রদানের মধ্যে তত্ত্বাবধায়করূপে হাজির থাকতে চান। কে বাউল-গুরু আর কে শিক্ষানবিশ, এই বিচারও সম্ভবত তাঁরা নিজেরা করবেন বলে সাব্যস্ত করেছেন। কর্মশালায় জমা হওয়া গানের মহাফেজখানা তো তাদের কাছে থাকলই। ইউনেসকোর নিয়োগপ্রাপ্ত মাঠকর্মীরা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার প্রতিভা নিয়ে আমাদের জানিয়ে দেবেন বাউলের সঠিক সংখ্যা। কিংবা ‘সঠিক’ বাউলের সংখ্যা। আর বছর বছর বাউল অ্যাডভোকেসি তো আছেই!

৩.
ইউনেসকো যেহেতু বিশ্বসংস্কৃতির তদারক করে থাকে, ফলে তারা নিজেদের এমন কর্তামূলক ভূমিকায় দেখতে চাইতেই পারে। কিন্তু তাদের বুঝতে হবে, যে তরিকায় বিপন্ন জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ সম্ভব, সেই তরিকায় একটা চালু সংস্কৃতির তদারকি সম্ভব নয়। বিশেষত সেটি যদি হয় বাউলগানের মতো কিছু। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বিপুল অংশ বাউলগানের শ্রোতা এবং সংগীত বাজারের প্রায় ৭০ ভাগ এখনো এই ধারার গানের দখলে। যদি তারা ভাবে যে বাউলগান কেবলি ছেঁউড়িয়ায় বা বাউল আখড়ায় চর্চার বিষয়, তাহলে তারা জলের উপরিতলে হিমশৈলের চূড়াটুকুই দেখতে পাচ্ছে। সাংস্কৃতিক চর্চা হিসেবে বাউলগান আখড়ার গণ্ডির বাইরে চলে এসেছে বহুকাল আগেই। সেটা ঘটেছে খোদ লালন শাহর জীবদ্দশায়। জীবনচর্চায় প্রথাগত অর্থে বাউল নন, কিন্তু বাউলগানের চর্চা করেন, এমন শিল্পীর সংখ্যা ক্রমে বেড়েছে। ফলে প্রথম দিকে তাদের যেমন ঢালাওভাবে ‘ভণ্ড’ বা ‘ফেক’ বাউল ভাবা হতো, সে রকম ভাবনার পরিসরও সংকুচিত হয়ে এসেছে ধীরে ধীরে। আর এই ভাবনাটা কিন্তু গোড়া থেকেই বাউলের অথেনটিসিটির তরফে রক্ষণশীল শিক্ষিত মধ্যবিত্তেরই ভাবনা। খোদ বাউল তাঁর অথেনটিসিটি নিয়ে এ রকম ভাবিত ছিলেন, তেমন সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। যাঁরা কেবল গানের সুবাদে বাউল, তাঁরাও তাঁদের ‘বাউল শিল্পী’ হিসেবেই পরিচয় দেন। অর্থাৎ তাঁরা যে বাউলচর্চার অর্থোডক্স ধারার বাইরে অবস্থান করছেন, তা জানাতে কার্পণ্য করেন না। এ ধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়া না থাকলে বাউলগানের ব্যাপ্তি এতদূর ছড়াতে পারত কি না সন্দেহ।
খেয়াল করা দরকার, বাউলগান বিপন্ন সংস্কৃতি না হলেও একটি সাংস্কৃতিক বর্গ হিসেবে খোদ বাউল কিন্তু বিপন্নতার মধ্যে আছে। বাউলকে ধরে তওবা পড়ানো হচ্ছে, চুলদাড়ি কেটে দেওয়া হচ্ছে। এটাকে নিশ্চয়ই একটি ফ্যাসিবাদী ও ফ্যানাটিক আগ্রাসন হিসেবে পাঠ করা যায়। অথচ এর বিরুদ্ধে ইউনেসকোর কোনো কর্মসূচি নেই। সে বাউলগানকে রক্ষা করতে চায়, খোদ বাউলকে নয়। আবার তার ‘সঠিক’ বাউলের সংখ্যা নিরূপণের খায়েশও আছে, ফলে সে বাউলশুমারি করতে চায়। অর্থাৎ, বাউলের ‘সঠিকত্ব’ নির্ধারণের দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষিত উচ্চবর্গ আবারও বাউলের নিয়ন্ত্রণ চায়, ইতিমধ্যে যেটা গ্রামীণ ও শহরমুখী নিম্নবর্গ তার হাইব্রিড সংগীতচর্চার মধ্য দিয়ে দখল করে নিয়েছে। আর এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারলেই বাউল ডিসকোর্সকে অবাউল নিম্নবর্গের নানা ধরনের চর্চা থেকে মুক্ত করে একটা পরিপূর্ণ এগজটিক ঐতিহ্য হিসেবে জাদুঘরে পাঠানো সম্ভব!
গানের ঘরানার বিপরীতে ‘বাহিরানা’ নামে একটি ধারণার প্রস্তাব করেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বাংলার লোকসংগীত প্রসঙ্গে। ঘরানা বলতে কোনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্মুখী চলাচলের ধারণা বোঝানো হয়; আর হেমাঙ্গ-কথিত বাহিরানা মূলত কোনো সাংস্কৃতিক চর্চার বহির্মুখী প্রসারের কথা বলে। বাউলগানের ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্যকে বোঝার জন্য তাকে ঘরানা নয়, বরং বাহিরানা আকারে দেখা দরকার। এই বাহিরানা ক্রিয়াশীল আছে বলেই বাউলিয়ানার চর্চা আজও বাঙালিয়ানার নানান পরিসরে উৎপাদিত হয়ে চলেছে। এ জায়গা থেকে বিবেচনা করলে, ইউনেসকোর কর্মসূচি নেহাতই একটা শুদ্ধতাবাদী কর্মসূচি, যা বাউলগানকে একটা অথেনটিসিটির ঘেরাটোপে ফেরত নিতে চায়। এর ফলে ‘আসল বাউল’-এর নির্ধারকরূপে এনজিও-বাহিত নাগরিক উচ্চবর্গ যেমন তার নৈতিক গোয়েন্দাগিরির জায়গা পুনরুদ্ধার করবে, তেমনি বাংলার বিস্তীর্ণ নিম্নবর্গ হারাবে তাদের বহুযুগের সৃজনশীল বাঙালিয়ানা চর্চার এখতিয়ারটুকু।
সুুমন রহমান: কবি, গল্পকার, সংস্কৃতি-গবেষক; ইউনিভার্সিটি অব লিবারাল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষক