ব্যবসার ধারণায় মানুষের সেবা

নগরের ডিসি রোডে অনেস্টের কার্যালয়ে বিক্রির জন্য রাখা পোশাক বাছাই করছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা প্রিয়তি বড়ুয়া।  প্রথম আলো
নগরের ডিসি রোডে অনেস্টের কার্যালয়ে বিক্রির জন্য রাখা পোশাক বাছাই করছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা প্রিয়তি বড়ুয়া। প্রথম আলো

তিন কক্ষের ছোট্ট একটি বাসা। কোনো কক্ষে ঠাসা কাপড়চোপড়ে। কোনোটিতে বই-খাতা-কলম। আছে চাল-ডাল থেকে নানা ওষুধপথ্য আর চিকিৎসার সরঞ্জামও। স্বাভাবিক নিয়মে এটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরই চিত্র। তবে এই প্রতিষ্ঠানের গল্পটা একেবারে ভিন্ন। এখানে প্রায় সব পণ্য বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে তো মেলেই, তার সঙ্গে আবার পণ্যের লাভের ৬০ শতাংশও পেয়ে যান ক্রেতারা। আর প্রতিষ্ঠানটি যে লাভ করে তাও কারও পকেটে ঢোকে না। পুরোটাই ব্যয় হয় মানবসেবায়। ভিন্নধর্মী এই অসাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির নাম—‘অনেস্ট’। প্রতিষ্ঠার দুই বছরেই যে প্রতিষ্ঠানটি অনেকের মন ছুঁয়েছে।

শুরুর গল্প

সংগঠনটির উদ্যোক্তা কর বিভাগের কমিশনার ও লেখক সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ। যিনি বাদল সৈয়দ নামেই পরিচিত। আরও কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীসহ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে তিনি ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই এই দাতব্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন। শুরু থেকেই তাঁদের উদ্দেশ্য একটাই—সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ এবং শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো। 

নগরের ডিসি রোডে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে শুরু হয় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। তিন তরুণ ও এক তরুণী এখানে সার্বক্ষণিক সময় দেন। তাঁদের সহযোগিতা করেন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া ১৭ স্বেচ্ছাসেবী। বাজারমূল্যের অনেক কমেই এখানকার পণ্যগুলোর দাম নির্ধারণ করা হয়। 

আবার সেই মূল্যের লাভের ৬০ শতাংশ ভাগ পান ক্রেতারা। এটি মূলত অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেস্ট নামে খোলা পেজেই সব পণ্যের ছবি তুলে দেওয়া হয়। অনলাইনে অর্ডার করলেই ক্রেতার ঘরে পৌঁছে যায় পণ্য। সে ক্ষেত্রে কুরিয়ার সার্ভিস ফি দিতে হয়। তবে প্রতিষ্ঠানে গিয়েও পণ্য কেনা যায়। সারা দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ক্রেতারা পণ্য কিনতে অর্ডার দিতে পারেন। গড়ে প্রতি আট মিনিটে একটি পণ্য বিক্রি হয় এই প্রতিষ্ঠানে। 

 লাভবান ক্রেতারাও

অনেস্টে মূলত দুই ধরনের পণ্য বিক্রি হয়—দানে পাওয়া ও নিজেদের কেনা পণ্য। দানের পণ্যের ক্ষেত্রে যে দাম নির্ধারণ করা হয়, তার ৬০ ভাগই ফেরত পান ক্রেতারা। আবার অনেস্টের নিজের কেনা পণ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতা পান লাভের ৬০ শতাংশ। 

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর—এই ১০ মাসে অনেস্ট দান হিসেবে পাওয়া ৮ হাজার ৭৩২টি পণ্য বিক্রি করেছে। এসব পণ্যের বিক্রয়মূল্য ছিল প্রায় ৪১ লাখ টাকা। দান হিসেবে পণ্য বলে এসব টাকার ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন গ্রাহকেরা। আর বাকি ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেয়েছে অনেস্ট। 

অন্যদিকে এই সময়ে অনেস্ট কেনা পণ্য বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করেছে ৪ হাজার ৩৮৮টি। এসবের বিক্রয়মূল্য ছিল ১১ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠার পর এই দুই বছরে অনেস্ট কেনা পণ্য থেকে লাভ করেছে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৩৯৬ টাকা। এই লাভের ৬০ ভাগ অর্থাৎ ১ লাখ ৪১ হাজার ৮৩৫ টাকা তাৎক্ষণিকভাবে পেয়েছেন ক্রেতারাই। বাকি ৯৪ হাজার ৫৫৭ টাকা পেয়েছে অনেস্ট। 

 লাভের অর্থ মানবসেবায়

নতুন পণ্য কেনার ক্ষেত্রে অনেস্টে বাদল সৈয়দসহ কয়েকজন বিনিয়োগ করেন। তবে তাঁরা লাভের এক টাকাও গ্রহণ করেন না। তাঁরা এটিকে নিয়েছেন ‘চ্যারিটি মিশন’ হিসেবে। 

লাভের প্রায় পুরো অর্থই ব্যয় হয় মানবসেবায়। চারভাবে তাঁরা এই সেবা করছেন। এগুলো হলো, চিকিৎসা উপকরণ প্রদান, বিনা মূল্যে পণ্য বিতরণ,  ডোনেট ইট ফরওয়ার্ড ও শিক্ষাবৃত্তি। 

>মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই গড়ে তোলা হয় অনেস্ট নামের দাতব্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

অনেক অসহায় দরিদ্র মানুষ আছেন যাঁদের পক্ষে দামি চিকিৎসা সরঞ্জামাদি কেনা অসম্ভব। এসব অসহায় মানুষের মধ্যে সংগঠনের মাধ্যমে চিকিৎসা সরঞ্জাম দেওয়া হয়। প্রয়োজন শেষে তাঁরা পুনরায় সেই সরঞ্জামাদি ফেরত দেন। এ পর্যন্ত ৩৭ জন এই সেবা পেয়েছেন। এ ছাড়া বই, কাপড়, চিকিৎসার সরঞ্জামসহ নানা পণ্য অসচ্ছল মানুষকে বিনা মূল্যেও দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ৪২১টি পণ্য তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এ খাতে অনেস্টের ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার ৫০ টাকা। ডোনেট ইট ফরওয়ার্ডের আওতায় বিভিন্ন দাতাসদস্য থেকে পণ্য নিয়ে তা অন্যদের দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৮০টি পণ্য এই খাতের অধীনে মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষাবৃত্তিও দিয়ে আসছে অনেস্ট। দুই বছরে বিভিন্ন শিক্ষার্থীকে ভর্তির ক্ষেত্রে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। 

আবার কিছু পণ্য বাজারমূল্যের অর্ধেক দামেও বিক্রি করা হয় অনেস্টে। বাজারে পেঁয়াজের মূল্য কেজিতে ডাবল সেঞ্চুরি ছুঁয়েছে এই কয় দিনে। 

অথচ অনেস্টে সেই পণ্য বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৬০ টাকায়। প্রতি ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই কেজি পেঁয়াজ কেনার সুযোগ পান। তবে শুধু পেঁয়াজ নয়, যেসব পণ্য অতিপ্রয়োজনীয় কিন্তু বাজার থেকে অতিমূল্যে কিনতে হয়, সেসব পণ্য এখানে প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করা হয়। 

 অনেস্টে একদিন

ডিসি রোডের মৌসুমি মোড়ের উল্টো দিকে কিছু দূর এগোলেই চোখে পড়বে পাঁচতলা একটি ভবন। সেই ভবনের নিচতলার একটি বাসায় চলছে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দুই তরুণ ও এক তরুণী ব্যস্ত সময় পার করছেন। 

কেউ কাপড়ের মাপজোখ করছেন। কেউ বা তা লিখে নিচ্ছেন ল্যাপটপে। কেউ আবার ছবি তুলে নিচ্ছেন সেই পণ্যের। সব কাজ শেষ হতেই ফেসবুক পেজে সবিস্তারে তুলে দেওয়া হচ্ছে সেই পণ্য। সেখানে কথা হয় মনিরুল হক, মো. এনামুল হক ও প্রিয়তী বড়ুয়ার সঙ্গে। তাঁরা অন্য চাকরি ছেড়ে এখানে যোগ দিয়েছেন। কিছু সম্মানী পান বটে। তবে তাঁরা এটিকে নিয়েছেন মানবসেবা হিসেবে। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, একদিনে ৬০টি পণ্য আপলোড করা হলে দেখা যায় সেখানে ৫৫টিই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে দিনে অন্তত গড়ে ৩৩ হাজার টাকা বিক্রি হয়। 

এই তিনজনের সঙ্গে আছেন ম্রাংচিং মারমা নামের আরও একজন। যিনি স্থানীয় পর্যায় থেকে পণ্যগুলো সংগ্রহ করেন। 

অনেস্ট কেন খুলতে গেলেন এমন প্রশ্নে প্রতিষ্ঠানটির স্বপ্নদ্রষ্টা বাদল সৈয়দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পে ইট ফরওয়ার্ড নামের আরেকটি সংগঠনের মাধ্যমে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি সহায়তা দিয়ে আসছি। কিন্তু আমরা চাইছিলাম নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের পাশেও দাঁড়াতে। তাঁদের হাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে তুলে দিতে। সেই স্বপ্ন থেকেই মূলত এই চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানটি চালুর উদ্যোগ। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনতে সচ্ছল ব্যক্তিদের নিরুৎসাহিত করা হয়।’ 

বাদল সৈয়দ আরও বলেন, মূলত মানবসেবার জন্য এই ভিন্নধর্মী চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়েছে। এখানে লাভের ভাগ তো ক্রেতারা পান, আবার প্রতিষ্ঠানটির কাছে লাভের যে অংশ থাকে তাও ব্যয় হয় মানুষের কল্যাণে।