ভূত শিকারি

অলকংরণ: তুলি
অলকংরণ: তুলি

আমার বন্ধু মানিক, ভূত নিয়ে গবেষণা করে। ভূতে বিশ্বাস করে। আমি করি না। একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি দুজনে। এক ছুটির দিনে সে প্রস্তাব দিল, ‘চল, সোনারগাঁ ঘুরে আসি। অনেক পুরোনো বিল্ডিং আছে ওদিকে। ভূতটুত পাওয়া গেলেও যেতে পারে।’
আমার ইচ্ছে নেই। মানিকের চাপাচাপিতে দুপুরের খাওয়া সেরে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। বেরোনোর সময়ই লক্ষ করেছি, আকাশের অবস্থা ভালো না। মানিক তো মহাখুশি। ‘বৃষ্টি আসবে। ভালোই। দুর্যোগের মধ্যেই ভূতেরা বেরোয় বেশি।’
সোনারগাঁয়ে পৌঁছানোর আগে তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। শ খানেক গজ দূরে একটা পুরোনো লাল ইটের তিনতলা বিল্ডিং দেখিয়ে মানিক বলল, ‘ওখানে গিয়ে দেখি, বৃষ্টি থেকে বাঁচার উপায় করা যায় কি না।’
বাড়ির সামনে মোটরসাইকেল রেখে বারান্দায় উঠলাম। অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করার পর দরজা খুলে দিল এক বৃদ্ধ। বয়সের ভারে কুঁজো। হাতে একটা হারিকেন। বৃষ্টির দিনের সন্ধ্যা। অসময়েই অন্ধকার হয়ে গেছে।
বললাম, বিপদে পড়েছি। আমাদের ভালোমতো দেখল বুড়ো। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভেতরে ঢুকতে দিল।
ঝড় বাড়ছে। যা অবস্থা, তাতে রাতে আর থামবে বলে মনে হলো না। মানিকের প্রশ্নের জবাবে বুড়ো জানাল, সে এ বাড়ির কেয়ারটেকার।
আমাদের দোতলায় নিয়ে গেল বুড়ো। একটা ঘর দেখিয়ে দিল, ‘নিন, জামাকাপড় ছাড়ুন। রাতে আর খাবার দিতে পারব না।’
লাগবে না, ‘মানিক বলল।’ ‘ব্যাগে বিস্কুট আছে। পানিও আছে। রাত কাটিয়ে দিতে পারব।’
যেতে যেতে, দ্বিধা করে, কী ভেবে ঘুরে দাঁড়াল বুড়ো। ইতস্তত করে বলল, ‘একটা কথা...বৃষ্টি থামলেই চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এ বাড়িতে...’
‘থামলেন কেন?’ মানিক বলল। ‘এ বাড়িতে কী?’
‘ভূতের উপদ্রব আছে, ‘বুড়ো জানাল। ভয়ে ভয়ে তাকাল বাথরুমটার দিকে। বলল, ‘বাড়িটা এক ইংরেজ সাহেবের। ওই বাথরুমে মরে পড়েছিল­। ইস্পাতের বাথটাবের কানায় বাড়ি খেয়ে। মাথায় বাড়িটা লেগেছিল। এরপর বাড়িটা কেনেন এক বাঙালি জমিদার, ব্রজমোহন চৌধুরী। জমিদার দেখলেন, বাড়ির বেশির ভাগ ফিটিংসই নষ্ট হয়ে গেছে। সংস্কারকাজ শুরু করলেন তিনি। সবকিছু শান্ত স্বাভাবিকই থাকল, যতক্ষণ না বাথরুমের মরচে পড়া ইস্পাতের বাথটাব সরানোর চেষ্টা করা হলো। কিছুতেই সরানো গেল না টাবটা। কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন বিপুল শক্তিতে আটকে রাখল ওটাকে। সেদিন থেকে আরও একটা ঘটনা ঘটতে লাগল, একজন বৃদ্ধ মানুষের ভূত দেখা দিতে শুরু করল বাড়িটায়। ভূতের প্রথম শিকার ব্রজমোহনের বড় মেয়ে চৌদ্দ বছরের কনিকা। ঘুমের মধ্যে তার গলা টিপে ধরল ভূতে। চেঁচামেচি শুরু করলে ভূতটা তাকে ছেড়ে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। পরদিন আক্রান্ত হলো কনিকার চার বছরের বোন মনিকা। এরপর প্রায় প্রতিদিনই নানা রকম ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে লাগল বাড়িটাতে।
সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে ব্রজমোহনের পরিবার। বিশেষ করে রাতের বেলা। ভূতের অত্যাচারে শেষে আর কোনো উপায় না দেখে একজন ওঝা ডেকে আনলেন ব্রজমোহন। কিছুই করতে পারল না ওঝা। হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। টিকতে না পেরে ব্রজমোহনও সপরিবারে বাড়ি ছাড়লেন। আমাকে রেখে গেলেন কেয়ারটেকার হিসেবে।’
‘ভূতটা আপনাকে কিছু করে না?’ উত্তেজিত হয়ে মানিক জিজ্ঞেস করল।
মাথা নাড়ল কেয়ারটেকার। ‘মাঝে মাঝে করে না তা নয়। কিন্তু কী করব? গরিব মানুষ। সংসারে কেউ নেই, একেবারেই একা। একটা নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছি। এখানেই নিচতলার একটা ঘরে পড়ে থাকি। এ ঘরে বিশেষ আসি না।’
চলে গেল বুড়ো। মানিক বলল, ‘আমি আজ ওটাকে তাড়াবই।’
‘কীভাবে তাড়াবি?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘বুদ্ধি খরচ করে। যুক্তি দিয়ে বোঝাব ভূতটাকে।’
হেসে উঠলাম। আমার দিকে তাকাল মানিক। ‘হাসো, হাসো, যত খুশি আমাকে নিয়ে ইয়ার্কি মারো। তবে ভূতে বিশ্বাস আজ আমি তোকে করিয়েই ছাড়ব।’
আসবাবপত্র নেই ঘরে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেতেই বসে রইলাম দুজনে। অনেক রাতে ঢুলতে শুরু করেছি, হঠাৎ আমার গায়ে ঠেলা দিয়ে ফিসফিস করে মানিক বলল, ‘এই রাজিব, ওঠ! ভূত!’
অবাক হয়ে দেখলাম ছায়ামূর্তিটাকে। মুখটা কাগজের মতো সাদা। অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে। তবে চেহারা চেনা যাচ্ছে না।
ভূতটাকে জিজ্ঞেস করল মানিক, ‘আপনি কে? এ বাড়িতে কী করেন?’
আশ্চর্য! কথা বলে উঠল ভূতটা। বলল, ‘কই, আমি তো জানি না আমি ভূত হয়ে গেছি। আমি তো আমার বাড়িতেই আছি।’
‘আপনি যে মারা গেছেন, সেটা জানেন?’
‘না। তবে একটা অশান্তি, অতৃপ্তি...ঠিক বুঝতে পারি না।’
‘তার মানে আপনার অশান্ত আত্মা অতৃপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই বাড়িতে।’
‘আমি মুক্তি পাব কী করে?’
‘পাবেন না, যতক্ষণ না এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।’
‘জানালা দিয়ে উড়ে যান...কিংবা...কিংবা...বাথরুমের বাথটাবে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। যেটাতে বাড়ি খেয়ে আপনি মারা গেছেন। শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকুন...যাচ্ছি...যাচ্ছি...যাচ্ছি...’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভূতটা। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন...’
টলতে টলতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল ভূতটা।
হাসতে হাসতে মানিক বলল আমাকে, ‘কী রাজিব মিয়া, কী খেলটা দেখালাম। এখন তো বিশ্বাস করছিস, ভূত আছে?’
‘না।’ জবাব দিলাম।
ঠিক এই সময় বুটের শব্দ তুলে ঘরে ঢুকল চার-পাঁচজন লোক। একজনের হাতে উজ্জ্বল টর্চ জ্বলে উঠল। অবাক হয়ে দেখলাম, ওরা পুলিশের লোক।
একজন অফিসার পিস্তল উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে আপনারা? এখানে কী করছেন?’
পরিচয় দিয়ে জানালাম, বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি।
‘লোকটা কোথায়? কেয়ারটেকার?’ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন।
‘নিচেই হয়তো আছে, তার ঘরে,’ মানিক জবাব দিল।
‘না, নেই। নিচতলার কোনো ঘরেই নেই। দরজার বাইরে থেকে শুনলাম, কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন?’ ধমকে উঠলেন অফিসার, ‘জলদি বলুন, লোকটা কোথায়?’
লোক নয়, ভূত, ‘হাসিমুখে মানিক বলল। তাড়িয়ে দিয়েছি। ওই বাথরুমে।’
বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধাক্কা দিয়ে কবজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল পুলিশ। টানতে টানতে বের করে আনল ভূতটাকে। হাতকড়া পরিয়ে দিল। হেসে বললেন অফিসার, ‘কত দিন আর পালিয়ে থাকবে, বালতি? হেহ্ হেহ্ বাবা, আমি ইন্সপেক্টর জলিল শিকদার। আমার চোখে ধুলো দেওয়া এত্ত সহজ না।’ টান দিয়ে ভূতটার মুখের রবারের মুখোশ খুলে ফেললেন তিনি। বেরিয়ে এল একজন যুবকের মুখ।
আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন অফিসার, ‘এই ব্যাটার নাম বালতি খোকন। এক মহিলাকে খুন করে ঘরের সব টাকাপয়সা, অলংকার লুট করে এখানে এসে কেয়ারটেকারের ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে। কেউ এদিকে এলেই বানিয়ে বানিয়ে ভূতের গল্প শোনায়। এভাবে গুজব ছড়িয়ে মানুষকে দূরে রাখার চেষ্টা করে, যাতে নিজে নিরাপদে থাকতে পারে।’ সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটাকে গাড়িতে তোলো।’
‘তার মানে আমাদেরও মিথ্যা ভূতের গল্প শুনিয়েছে?’ হতাশ কণ্ঠে বলল মানিক।
তা ছাড়া আর কি, যদি আপনারা তার দোসর হয়ে না থাকেন, শীতল কণ্ঠে বললেন ইন্সপেক্টর। আপনাদেরও থানায় যেতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের পর যদি বুঝি নিরপরাধ, ছেড়ে দেওয়া হবে।
করুণ চোখে আমার দিকে তাকাল মানিক। ‘রাজিব!’
ঝাঁজিয়ে উঠলাম। ‘এখন আর রাজিব রাজিব করে কী হবে! কতভাবে বোঝালাম, ভূত বলে কিছু নেই। শুনলে না। করো এখন ভূত শিকার!’