ভয় নেই, আমরা আছি
তখন করোনার চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছিল আতঙ্ক। গত বছরের মার্চ-এপ্রিলের কথা। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ তখন গ্রামে, নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু ডেন্টাল সার্জন নুরুন্নাহারের বাড়ি যাওয়ার উপায় ছিল না। ৩৯তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই চিকিৎসক নিয়োগ পেয়েছিলেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে তখন নানা শঙ্কা, কুসংস্কার। অন্য এলাকা থেকে কেউ গ্রামে এলেই তাঁকে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছিল। ব্যাহত হচ্ছিল হাসপাতালের সাধারণ সেবা। বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্ত নেন, নিজেরাই পালা করে রোগীদের বাসায় যাবেন। বাসায় না জানিয়ে এই ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসকদের দলে যোগ দেন নুরুন্নাহারও। কাজ শুরুর ছয় মাসের মাথায় তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। মা–বাবা আতঙ্কিত হবেন, এই ভয়ে কোয়ারেন্টিনের নিঃসঙ্গ ও দুঃসহ দিনের কথাও নিজের ভেতরে পুষে রেখেছিলেন। সুস্থ হয়ে আবার কাজে যোগ দেন তিনি।
একইভাবে বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত সহকারী সার্জন মার্জিয়া আহসানও রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন। তিনি দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। রাজশাহীতেই বাড়ি। দুই দিন বের হওয়ার পরই করোনায় আক্রান্ত হন তিনি। তাঁর স্বামী আবুল হাসনাতও একই হাসপাতালের চিকিৎসক। সে সময় স্বামী–স্ত্রী একই সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
ডেন্টাল সার্জন হলেও ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দলে যোগ দিয়ে আক্রান্ত নারীদের কাছে ত্রাতা হয়ে উঠেছিলেন নুরুন্নাহার। নমুনা সংগ্রহ ও সাধারণ চিকিৎসা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা ডেন্টাল কলেজের এই প্রাক্তন ছাত্রী। ৪ মার্চ বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে কথা বলতে বলতেই রোগীর ভিড় সামাল দিচ্ছিলেন তিনি।
সেই সময়ের ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা প্রসঙ্গে নুরুন্নাহার বললেন, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম রাব্বানী এই ব্যতিক্রমী চিন্তার উদ্ভাবক। তাঁর জন্যই সম্ভব হয়েছে। তবে হাসপাতালে করোনা রোগীদের না এনে যখন চিকিত্সকদেরই রোগীদের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, তখন প্রথমেই নুরুন্নাহারের মনে পড়ে নারী রোগীদের কথা। অনেকে পুরুষ চিকিৎসকদের কাছে অনেক কথা বলতে চান না, পরিবারেও তাঁরা সব সুবিধা পান না। তাই তিনি নিজে থেকেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়েও নারী রোগীদের সেই অসহায়ত্বই চোখে পড়েছে আমার। একজন নারী গাজীপুরের তৈরি পোশাক কারখানা থেকে বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁর করোনার লক্ষণ ছিল। পরিবারের লোকজন তাঁকে জানালাহীন একটি ঘরের মধ্যে রেখে ছিলেন। আতঙ্কেই তাঁর মরে যাওয়ার অবস্থা।’
নুরুন্নাহাররা গিয়ে লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়েছেন। নমুনা এনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন। পরে জানা যায়, লক্ষণ থাকলেও তিনি করোনা পজিটিভ ছিলেন না। রিপোর্ট পাওয়ার পরই ওই নারী বদ্ধ ঘরের বাইরে আসার সুযোগ পান এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই অভিজ্ঞতার কথা নুরুন্নাহার জীবনেও ভুলবেন না।
নুরুন্নাহার বলেন, ‘আগস্টের শেষের দিকে আমি করোনায় আক্রান্ত হই। সে সময় বদলির জন্য আমার সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে যাওয়া কথা ছিল। কিন্তু কোয়ারেন্টিনে ছিলাম বলে যেতে পারছিলাম না। বাবা বারবার ফোন করে জিজ্ঞাসা করছিলেন, আমি কেন যাচ্ছি না। তিনি দুশ্চিন্তা করবেন, সেই ভয়ে কারণটা বলতেও পারছিলাম না।’ বিদেশে অবস্থানরত ভাইকে শুধু পরিস্থিতির কথা জানিয়েছিলেন তিনি। ভাই-ই তাঁকে মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন।
মার্জিয়া আহসানের সঙ্গে কথা হলো মুঠোফোনে। তিনি বলেন, ‘সে সময় গ্রামের মানুষ আমাদের দেখে স্বস্তি পেয়েছেন। আমরা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়েছি, তখন তাঁদের ভয় কেটে গেছে।’ স্বামীসহ মার্জিয়া যখন করোনায় আক্রান্ত হন, দুজন রাজশাহী শহরের বাসায় গিয়ে থেকেছেন। সন্তানকে আলাদা রাখতে হয়েছিল।
মহামারির সেই দুঃসময়ে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকেরা নিজেরাই ৩৬২ জন রোগীর বাসায় গিয়ে চিকিৎসা দেন। এ ব্যাপারে বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘আমাদের দলে নারী চিকিৎসক থাকায় নারী রোগীরা ভালো সেবা পেয়েছেন। রোগীরা এখনো ফোন করে বাড়িতে যেতে বলেন।’