রাষ্ট্রকেই বসতে হবে চালকের আসনে

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসনের জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত সরকারের সদিচ্ছা। ছবি: তানভীর আহমেদ
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসনের জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত সরকারের সদিচ্ছা। ছবি: তানভীর আহমেদ

দেশের সব নাগরিকের জন্য সক্ষমতা অনুযায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গীকার। সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন রূপকল্পের অন্যতম মাইলফলক। তবে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন যাপন করছে। টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের অনেকটিই, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, দারিদ্র্যমোচন ও নিরাপদ আবাসনের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষার আলো, স্বাস্থ্যসেবা ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হলে সর্বাগ্রে দরকার নিরাপদ আবাস।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশের নগরাঞ্চলে বাসস্থানের ঘাটতি ছিল ৪৬ লাখ, যা ২০২১ সাল নাগাদ হবে ৮৫ লাখ। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে নগরাঞ্চলে ৪৪ শতাংশ পরিবার কাঁচা ঘরবাড়িতে আর ২৯ শতাংশের বসবাস আধা পাকা বাড়িতে। বাংলাদেশে যদিও পাঁচসালা পরিকল্পনাসহ অন্যান্য জাতীয় পরিকল্পনায় আবাসন খাতকে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়েছে, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আবাসন নীতিমালাও প্রকাশিত হয়েছে, তবে বাস্তবে নিম্নবিত্তের আবাসনের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। সরকারি পর্যায়ে গৃহীত প্রকল্পগুলো প্রকৃত নিম্নবিত্ত মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বা তাদের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না কিংবা নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচের কারণে অভীষ্ট দরিদ্র জনগোষ্ঠী এই সব প্রকল্পের আওতার বাইরেই রয়ে গেছে।

বেসরকারি খাত উচ্চবিত্ত, হালে মধ্যবিত্তের আবাসনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই; কিন্তু দেশের ৪০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্তের আবাসনের ক্ষেত্রে তাদের একেবারেই কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। আবাসনের বাণিজ্যিক বাজারে স্বল্পবিত্তের চাহিদা অনুযায়ী কোনো আবাসন নেই, যদিও তারা এই ঢাকা শহরে মাসিক গড়ে প্রতি স্কয়ার ফুটে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা ভাড়ায় বস্তিতে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এই ভাড়া অনেক ক্ষেত্রে অভিজাত এলাকার ভাড়ার চেয়ে বেশি। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে অনেক পরিবারের হয়তো ভিটেমাটি আছে, কিন্তু ঘরটাকে মজবুত করার আর্থিক সংগতি নেই।

মৌলিক অধিকারে বৈষম্য কমিয়ে দেশের উন্নয়নের চাকা গতিশীল রাখতে শ্রমজীবী দরিদ্র জনগণের নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রকেই চালকের আসনে বসতে হবে। এমনকি বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতেও সরকারের অগ্রণী ভূমিকার প্রয়োজন। দেশের দরিদ্রপীড়িত জনগণের জন্য নিরাপদ আবাসন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যার কার্যক্রম কয়েক দশক ধরে চলতে পারে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসনের জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত সরকারের সদিচ্ছা, অভীষ্ট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য পেশাজীবী ও দক্ষ জনবল সমন্বয়ে সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় পরিকল্পনার আলোকে নগর ও গ্রামপর্যায়ে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের সময়েই স্বল্পবিত্তের আবাসনের জন্য স্থান নির্ধারণ করা একান্তই জরুরি। অর্থের সংস্থান স্বভাবতই সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ সংস্থা ও দাতা সংস্থার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে।

শহর ও গ্রামাঞ্চলে সাধ্য ও পারিবারিক চাহিদা অনুসারে আবাসনের মডেলে ভিন্নতা থাকবে। বড় শহরে বস্তিবাসীদের জন্য ওই জমিতেই অপরিহার্য নাগরিক সুবিধাদিসহ তাদের সাধ্যের মধ্যে আবাসনের ব্যবস্থা করার বেশ কিছু সফল উদাহরণ বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে মালিকানার বদলে ভাড়া বাসার কথা চিন্তা করাই যৌক্তিক। কারণ, এই সব শহরে জমির দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ছাড়া সোশ্যাল হাউজিংয়ের মডেল অনুযায়ী সরকারি–বেসরকারি কিংবা যৌথ উদ্যোগে ভাড়ার বিনিময়ে আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনা করে দরিদ্র মানুষের আবাসনের পরিকল্পনা করা যায়। উচ্চ ও মধ্যম আয়ের বহু দেশেই সোশ্যাল হাউজিং আছে। স্বল্পবিত্তের আবাসন নিয়ে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য–উপাত্ত প্রকল্প প্রণয়নে দিকনির্দেশনা দিতে পারে। সর্বোপরি সরকারকে অবশ্যই জাতীয় বাজেটে দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের আবাসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। একটি সুবিধাভোগী শ্রেণির রাজউক ও অনুরূপ সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে রাতারাতি প্লটের মালিক বনে যাওয়াটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্লট বরাদ্দের এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দেশে ন্যাশনাল হাউজিং অথরিটির অনেক প্রকল্পই আছে, কিন্তু প্রকৃত দরিদ্র মানুষের আবাসনের চাহিদা অনুযায়ী তেমন কোনো প্রকল্পই সংস্থাটি হাতে নেয়নি। সরকারি উদ্যোগে আবাসন প্রকল্প একমাত্র দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করেই হতে পারে।

শহরে বা গ্রামে যাদের সামান্য হলেও জমি আছে, তাদের জন্য প্রয়োজন আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে স্বল্প সুদে গৃহঋণের তেমন কোনো ব্যবস্থা এখনো অনুপস্থিত। দেশে বর্তমানে প্রচলিত উচ্চ সুদের গৃহঋণ অনেক জমির মালিককে বাড়ি তৈরির ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হাউজিং ও বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট বেশ কিছু সাশ্রয়ী মূল্যের নির্মাণসামগ্রী উদ্ভাবন করেছে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে আনতে পারবে। ছোট পরিসরে দেশেও এলাকাবাসী ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করে স্বল্প ব্যয়ে আবসন প্রকল্পে সফলতা পেয়েছে। বাংলাদেশে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোনের কাজ চলছে, যেখানে শ্রমজীবী মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বেশ কিছু সফল প্রকল্প আছে। ভারতের মিনিস্ট্রি অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট ও ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগে আগামী ২০২২ সাল নাগাদ গ্রামাঞ্চলে তিন কোটি বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

দেশ ও বিদেশের এই সব প্রকল্পের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে আমাদের দেশের উপযোগী কিছু মডেল তৈরি করা যেতে পারে। মডেল প্রকল্পের নকশা প্রণয়নের সময় প্রকল্পের ভৌগোলিক অবস্থান, অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, চাহিদা, সক্ষমতা, জমির দাম, ভূমির ব্যবহার ইত্যাদি বিবেচনা করে প্রকল্পে নাগরিক সুবিধাদিসহ প্রকল্প এলাকা ও ভবনের স্থাপত্য নকশা প্রস্তুত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আবাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি সংস্থা, আর্থিক সংস্থা, গবেষক, কারিগরি-পেশাজীবী জনবলের সমন্বয়ে ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও সাধ্যের আলোকে সার্বিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি করা দরকার। এসডিজি অর্জন করতে হলে স্বল্পবিত্তের আবাসনের ওপর গুরুত্ব দিতেই হবে। তাই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাজেট বরাদ্দের সময় ভুলে গেলে চলবে না, শহরে এই শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীই দেশের অর্থনীতিকে ক্রমে সবল করছে আর গ্রামের কৃষক, জেলে সবুজ–নীল বিপ্লবের প্রধান নিয়ামক।

অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট