শেষ বেলা পর্যন্ত ছবি এঁকে যাব

কাজি গিয়াসউদ্দিন l ছবি: খালেদ সরকার
কাজি গিয়াসউদ্দিন l ছবি: খালেদ সরকার

ছবি আঁকায় জড়িত আছি প্রায় অর্ধশতক ধরে, যার মধ্যে দীর্ঘ চার দশক আমার কেটেছে জাপানে। চারুকলা ইনস্টিটিউটে ছবি আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক পাট চুকিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়েছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর চারুকলাতেই শিক্ষকতার শুরু, যে সূত্র ধরে ১৯৭৫ সালে জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে জাপানে আমার আগমন। জাপানের বিখ্যাত সংগীত ও চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভের পর দেশে ফিরে না গিয়ে এখানেই আমার থেকে যাওয়ার পেছনে আছে পারিবারিক কারণ। দেশে ফিরে গেলে হয়তো শিক্ষকতার পেশাতে আবারও ফিরে যাওয়া হতো, আর সেই সঙ্গে চলত ছবি আঁকা। সেই জীবন ঠিক কেমন হতো, তা নিয়ে এখন আর আমি তেমন ভাবি না। কেননা আমার মনে হয়, শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারার পেছনে জাপানের শিক্ষা আমার জীবনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে। জাপানের অভিজ্ঞতা নিজের শিল্পীসত্তার পরিচয় খুঁজে পেতে নানা দিক থেকে আমাকে সাহায্য করেছে।
আমার শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনের অনুপ্রেরণা কোথা থেকে এসেছে, তা সঠিকভাবে বুঝে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা আমাদের পরিবারে কেউ ছবি আঁকায় কখনো জড়িত হয়নি। গানবাজনার চর্চাও পরিবারে সেভাবে ছিল না। গ্রামীণ পরিবেশে অন্য দশটি পরিবারের মতোই আমাদের পরিবারকেও মধ্যবিত্তের সংগ্রামী জীবনের মধ্যে দিয়ে কাটাতে হওয়ায় ছবি আঁকার শিল্পীর মতো অনিশ্চিত পেশায় পা বাড়ানোর পথে উৎসাহ সেভাবে মেলেনি। তবে তা সত্ত্বেও সেই বাল্যকালে গাছের ভাঙা কোনো ডাল হাতে নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর সময় মাটিতে সেই ডালের ছোঁয়ায় ছবি আঁকাই সম্ভবত ছিল শিল্পের জগতের বন্ধ দরজায় আমার প্রথম করাঘাত। নিকটজনের উৎসাহ সেভাবে না পেলেও আশপাশের পরিবেশ কিন্তু ঠিকই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল কল্পনার ছবির পৃথিবীতে।
মনে পড়ে সেই কৈশোরে আমাদের গ্রামের কুমোরদের পাড়ায় গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম তাদের সব শৈল্পিক কাজ। কুমোরের ঘুরন্ত চাকতিতে মাটির দলার সুনির্দিষ্ট একটি রূপ লাভ করা আমাকে অবাক করে দিত। আর বিস্ময়ভরা চোখে আমি দেখতাম কাদামাটির সেসব সৃষ্টির সম্পূর্ণ নতুন চেহারা নিয়ে পোড়ানোর শেষে ভাঁটি থেকে বের হয়ে আসার পর এদের দেহ জুড়ে লেগে থাকা রঙের বাহারি সৌন্দর্য। কিশোর জীবনের বিস্ময়ভরা সেসব অভিজ্ঞতাই হয়তো ছিল ছবি আঁকায় লাভ করা আমার প্রথম পাট। আমার তো মনে হয় পারিপার্শ্বিকতা থেকে পাওয়া সেই শিক্ষা আজও আমাকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে চলেছে, যে অনুপ্রেরণার ছাপ হয়তো ফুটে উঠছে ক্যানভাসে প্রকাশ পাওয়া আমার রঙের খেলায়।

কখনো সারা রাত কেটে যায় আমার সেই সঙ্গীদের সাহচর্যে, কখনো আবার রঙের প্রলেপ মনের মতো না হলে পুরো ক্যানভাস মুছে দিয়ে আবারও হাত লাগাই একেবারে শুরু থেকে। বাংলাদেশে বেশ খোলামেলা আর বড় আকারের একটি স্টুডিও আমি করে নিয়েছি, যেখানে এই ছবি আঁকার খামখেয়ালীপনায় আমাকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই

জাপান আমাকে শিখিয়েছে রঙের পরিমিত ব্যবহারের গুরুত্ব। কোথায় কোন রং কীভাবে ব্যবহার করা দরকার, সেই শিক্ষা মনে হয় শিল্পীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাপানি চিত্রকলার যে দিকটি আমাকে মুগ্ধ করে, তা হলো রঙের সেই মাত্রাজ্ঞান। কোথাও নেই রঙের বাড়াবাড়ি রকম উপস্থিতি, তবে তারপরও চোখ আর মনজুড়ে যেন বয়ে যায় তৃপ্তির অনুভূতি। ঠিক সে রকম অনুভূতি আমি খুঁজে পাই জাপানের মৃৎপাত্রের শিল্পীদের কাজের মধ্যেও। এখানকার মৃৎশিল্পীরাও হচ্ছেন আমাদের দেশের অবহেলিত মৃৎশিল্পীদের মতোই খুবই উন্নত মানের শিল্পী, রঙের ব্যবহার যাঁদের কাজের মধ্যে দিয়ে আরও অনেক বেশি আকর্ষণীয়ভাবে ফুটে ওঠে। এঁদের কাজে রং আর আলো-ছায়ার প্রতিফলন আমি সব সময় অবাক হয়ে লক্ষ করি এবং এ কারণেই আমার মনে হয়, আমার কাজের মধ্যে রঙের প্রয়োগ আর ব্যবহারের দিক থেকে জাপানের রংতুলির শিল্পীদের চেয়ে এ দেশের মৃৎপাত্রের শিল্পীদের কাছে আমি যেন অনেক বেশি ঋণী।
জাপানে আমার শিক্ষাজীবন ছিল অনেকটা সময় ধরে বিস্তৃত। স্নাতক পর্যায়ের পাট চুকিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আমি ভর্তি হই টোকিওর সংগীত ও চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে, জাপানে যেটা এর সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ গেদাই নামে পরিচিত। একটি দিক থেকে আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করি। সেটা হলো আমি হচ্ছি নামী সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করা প্রথম ছাত্র। এই পরিচিতি জাপানে প্রতিষ্ঠা লাভে পরোক্ষভাবে কিছুটা সহায়ক হলেও শিল্পীর বেলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিন্তু প্রতিভা যাচাইয়ের মাপকাঠি হয়ে ওঠে না। ফলে জাপানে আমার এখন যেটুকু পরিচয়, তার সবটাই মনে হয় এসেছে আমার কাজের মধ্যে দিয়ে, যে কাজের খুঁটিনাটি নানা দিকের শিক্ষা আমি পেয়েছি গেদাই থেকে।
জাপানে আমার প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। প্রয়াত জাপানি রাজনীতিবিদ তাকেশি হায়াকাওয়া তখন ছিলেন জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির কর্ণধার। তাঁর ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতায় সেটা সম্ভব হয়েছিল। সেই প্রথম প্রদর্শনীর পর থেকে এ পর্যন্ত জাপানে এককভাবে আমার প্রদর্শনী হয়েছে ২৫টির মতো। এ দেশে ছবি যাঁরা সংগ্রহ করেন, আমার ছবি তাঁদের পছন্দ হওয়ায় বিভিন্ন গ্যালারি আমার প্রদর্শনীর আয়োজন করতে সব সময় এগিয়ে এসেছে। আর এর মধ্যে দিয়েই জাপানের শিল্পকলার জগতে একটু একটু করে পরিচিত হয়ে উঠেছি আমি।
অন্য যে আরেকটি দিক থেকে নিজেকে আমি কিছুটা হলেও ভাগ্যবান মনে করি, তা হলো এমন একসময়ে এই দেশে ছবির জগতে আমি প্রবেশ করেছি, ছবির কাটতি যখন ছিল সবচেয়ে বেশি। বুদ্বুদ অর্থনীতির সময় নামে পরিচিত সেই সময়ে জাপানিরা ছিল ছবির বাজারের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। শিল্পীকে যেহেতু সৃজনশীলতা অব্যাহত রাখার তাগিদে ক্রেতা-পৃষ্ঠপোষকের শরণাপন্ন হতে হয়, তাই ছবির বাজার সম্প্রসারিত হলে সৃজনশীলতাও সেই পথ ধরে বিস্তার লাভের সুযোগ পায়। জাপানে ১৯৮০–এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৯৯০–এর দশকের মাঝামাঝি সময়টা ছিল সে রকম এক সময়। ছবি বিক্রি হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের সংবাদমাধ্যমও আমাকে নিয়ে উৎসাহ দেখাতে শুরু করে। সেই সঙ্গে কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থাও এগিয়ে আসে আমার ছবির অ্যালবাম প্রকাশের প্রস্তাব নিয়ে। জাপানে এ পর্যন্ত আমার তিনটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চিকুমা শোবো প্রকাশনা কোম্পানির সাউন্ড অব নেচার।
জাপানের মতো শিল্প নিয়ে আগ্রহী একটি দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারা তেমন সহজ কোনো অবস্থাতেই নয়। ছবির বাজারে প্রতিযোগিতা এখানে ব্যাপক এবং নানা দেশের শিল্পীদের সেই বাজারে প্রবেশের লক্ষ্য নিয়ে নিয়মিতভাবে এই দেশে আসা-যাওয়া। একজন বাংলাদেশি হিসেবে সেই প্রতিযোগিতায় টিকে যাওয়ার পেছনে এ দেশের মানুষের আমার ছবি ভালো লাগা অবশ্যই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। তা ছাড়া দীর্ঘ এই পথচলায় কয়েকজন শিক্ষকের আন্তরিক সহযোগিতা আমি লাভ করতে পেরেছি এবং এর বাইরে কয়েকটি আর্ট গ্যালারিও সব সময় আমার দিকে প্রসারিত রেখেছে তাদের সহযোগিতার হাত। আর সেসব কিছুর সমন্বয়েই আজকের এই অবস্থানে আসতে পারা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেছে।
আজকাল বছরের বড় একটা সময় আমি বাংলাদেশে কাটাই। পরিবারের বাইরে জীবন আমার অনেকটাই একাকী এবং একাকী সেই জীবনে রংতুলি আর ইজেল হচ্ছে আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী। ছবি আঁকার মধ্যে ঢুকে যাওয়ার পর নিজে তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কাজ আমি শেষ করি না। কখনো সারা রাত কেটে যায় আমার সেই সঙ্গীদের সাহচর্যে, কখনো আবার রঙের প্রলেপ মনের মতো না হলে পুরো ক্যানভাস মুছে দিয়ে আবারও হাত লাগাই একেবারে শুরু থেকে। বাংলাদেশে বেশ খোলামেলা আর বড় আকারের একটি স্টুডিও আমি করে নিয়েছি, যেখানে এই ছবি আঁকার খামখেয়ালীপনায় আমাকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। ফলে বড় আকারের কাজের তাগিদ থাকলে সেখানে থাকা অবস্থাতেই সেগুলো আমি করে নিই। ক্লান্তি আমাকে এখনো স্পর্শ করেনি। তবে আর কত দিন আমি ক্লান্তির ভার থেকে মুক্ত থাকব, তা অবশ্য নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে এটুকু আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে একেবারে শেষ বেলা পর্যন্ত ছবি আমি এঁকে যাব। কেননা ছবিই তো হচ্ছে আমার জীবন এবং জাপানে আমার পরিচিতির পেছনের সবচেয়ে বড় উপাদান।

লেখক পরিচিতি
চিত্রশিল্পী কাজি গিয়াসউদ্দিনের জন্ম ১৯৫১ সালে মাদারীপুরে। জাপানে গিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালে শিল্পকলায় উচ্চশিক্ষা লাভের বৃত্তি নিয়ে। সেখানে শিল্পকলার ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নেন। বিমূর্ত ধারার শিল্পী হিসেবে জাপানে তিনি খ্যাতনাম। নিয়মিত একক প্রদর্শনীর বাইরে জাপানের বেশ কিছু জাদুঘর আর ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের কাছে রয়েছে তাঁর ছবি। এ ছাড়া জাপানে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আঁকা ছবির একাধিক অ্যালবাম।


সেসব কীর্তিগাথা শোনাচ্ছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কয়েকজন প্রবাসী: