সব সংকটের সমাধান ভূমি পুনঃ উন্নয়নে

পুরান ঢাকার বেশির ভাগ প্লটের আয়তন আধা কাঠা থেকে দেড় কাঠার মধ্যে। ছবি: হাসান রাজা
পুরান ঢাকার বেশির ভাগ প্লটের আয়তন আধা কাঠা থেকে দেড় কাঠার মধ্যে। ছবি: হাসান রাজা

গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনগুলো যেন ইট–পাথরের জঞ্জাল। বেশির ভাগ সড়ক এতটাই সরু যে সেগুলোকে গলি বলাই ভালো। ভবনে ভবনে গড়ে ওঠা গুদাম ও কারখানায় অতি দাহ্য বস্তুর ছড়াছড়ি। সব মিলিয়ে পায়ে পায়ে ছড়ানো ইতিহাস আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা বহন করে চলা পুরান ঢাকার একেকটি এলাকা যেন মৃত্যুকূপ। আর অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্পসহ যেকোনো ধরনের দুর্যোগের বিচারে রাজধানীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।

বিশেষজ্ঞ ও নগর–পরিকল্পনাবিদদের অভিমত, ভূমি পুনঃ উন্নয়ন বা ল্যান্ড রি–ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে পুরান ঢাকাকে ঢেলে সাজাতে না পারলে এখানকার বিদ্যমান সমস্যাগুলোর কোনোটিরই টেকসই ও স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজনে আইন করে ও এলাকার বাসিন্দাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে এটা বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশের নগর–পরিকল্পনার পরিসরে ভূমি পুনঃ উন্নয়নের বিষয়টি অনেকখানি নতুন ধারণা। এর আগে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বদলে গেছে সিঙ্গাপুরের চিত্র। একই পদ্ধতি বা এর কাছাকাছি মডেল অনুসরণ করে ঢেলে সাজানো হয়েছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ার অনেক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।

পুরান ঢাকার বেশির ভাগ প্লটের আয়তন আধা কাঠা থেকে দেড় কাঠার মধ্যে। এত ছোট প্লটে ভবন নির্মাণের জন্য অনুমোদন দেওয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ, এসব প্লটসংলগ্ন সড়কগুলোও অনেক সরু। এই অবস্থায় প্লটগুলোকে একত্র করে যদি তিন বিঘা, পাঁচ বিঘা আয়তনের একেকটি ব্লক তৈরি করা যায়, তাহলে সেখানে নতুন করে নির্মিত বহুতল ভবনে প্রত্যেকে একাধিক ফ্ল্যাট পেতে পারেন। এই পদ্ধতিতে জমির পরিমাণ ও সড়কের জন্য ছেড়ে দেওয়া জায়গার অনুপাত হিসাব করে কে কতটা ফ্ল্যাট পাবেন, সেটা নির্ধারণ করা যায়। সেই সঙ্গে ব্লকের মধ্যেই উন্মুক্ত স্থান, কমিউনিটি সেন্টার, ব্যায়ামাগার, বিনোদনকেন্দ্রসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধার সংস্থান করাটাও সহজ হয়, বিদ্যমান কাঠামো ঠিক রেখে যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর ভূমি পুনঃ উন্নয়নের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এর জন্য আলাদা করে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয় না। ফলে এটা ব্যয়সাশ্রয়ী। এ ছাড়া পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে ভূমির মালিক ও স্থানীয় ব্যক্তিদের মতামতকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

প্রায় আড়াই বছর আগে ঢাকার নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রণয়নের জন্য এলাকাভিত্তিক জনমত যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ভূমি পুনঃ উন্নয়নের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে। পুরান ঢাকার হরনাথ ঘোষ সড়কের বাচ্চু সরদার ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভায় ড্যাপ প্রণয়ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও দুই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিসহ বকশীবাজার, চাঁদনীঘাট, চকবাজার, মৌলভীবাজার, পুরোনো জেলখানা এলাকা, ইসলামবাগ, রহমতগঞ্জ ও বাবুবাজার এলাকার পাঁচজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অংশ নেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প সময়ের মধ্যেই বংশালে ৩০ বিঘা ও ১০ বিঘা আয়তনের দুটি জায়গা চিহ্নিত করে এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় রাজউক। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকনও এ কাজে অংশী হন স্থানীয় বাসিন্দাদের রাজি করানোর জন্য। তবে শেষ পর্যন্ত রাজউকের কর্মকাণ্ডের প্রতি আস্থাহীনতার কারণ দেখিয়ে বংশালের স্থানীয় লোকজন এ প্রকল্পে আগ্রহী হননি।

একই বছর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ওই এলাকার ৬০ একর জায়গাকে ভূমি পুনঃ উন্নয়নের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর আরেকটি পরিকল্পনা করে রাজউক। সর্বশেষ চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি রাজউকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির তৎকালীন চেয়ারম্যান, ট্যানারির মালিকদের প্রতিনিধি ও নগর বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে মতবিনিময় সভা হয়। সভায় হাজারীবাগ এলাকা নিয়ে তৈরি একটা খসড়া নকশাও উপস্থাপন করা হয় রাজউকের পক্ষ থেকে। সেই নকশায় এলাকাটিকে একটা মিশ্র অঞ্চল (আবাসিক ও বাণিজ্যিক) হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়।

ওই সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি রাজউক।

সার্বিক বিষয়ে নগর–পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ধরনের দুর্নীতি কিংবা দীর্ঘসূত্রতা ছাড়াই রাজউক যে কাজটি করতে পারবে, এর কোনো প্রমাণ তারা এখন পর্যন্ত রাখেনি। ফলে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা যে রাজউকের প্রতি আস্থা আনতে পারবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

ভূমি পুনঃ উন্নয়নের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজউকের নগর–পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ভূমি পুনঃ উন্নয়নের জন্য সমগ্র পুরান ঢাকার ১১টা ওয়ার্ড নিয়ে আমরা একটা অ্যাকশন এরিয়া প্ল্যান তৈরি করেছি।

এত দিন এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা কিংবা আইনগত ভিত্তি ছিল না। তাই ড্যাপে এর একটা আইনগত ভিত্তি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইমারত নির্মাণ বিধিমালাতেও আমরা এ–বিষয়ক দু–একটা ধারা অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি।’

আশরাফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘পুরান ঢাকার অনেক বাসিন্দার ধারণা, ভূমি পুনঃ উন্নয়নের আওতায় এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোও ভেঙে ফেলা হবে। কিন্তু আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই যে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো একই রকম রেখে কীভাবে এর ব্যবহার বাড়ানো যায়, আমরা ছোট ছোট পরিসরে সেই চেষ্টাই করব। সবকিছু যে বড় আকারে করা হবে, এমন নয়। যেমন কোনো ঐতিহাসিক ভবন কিংবা এলাকায় আমরা ওয়াকওয়ে তৈরি করে দিলাম। ফুটপাতগুলো সুন্দর করে দিলাম। আবার যে সরু সড়কে গাড়ি চলে না, সেই জায়গা আমরা বিকেল কিংবা সন্ধ্যাবেলার জন্য পাবলিক পরিসর হিসেবে ঘোষণা করে দিলাম। বাচ্চারা খেলল, বড়রা হাঁটলেন। আবার ভবনের রং যদি বদলে দেওয়া যায়, এমন অনেক বিষয় আমরা পুনঃ উন্নয়নের আওতায় আনতে চাই।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, পুরান ঢাকা যে ঢাকার সবচেয়ে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে জায়গাটিকে ঢেলে সাজাতে ভূমি পুনঃ উন্নয়নই একমাত্র সমাধান। তবে এখানে অতি উঁচু ভবন নির্মাণ কাম্য হবে না। আর খেয়াল রাখতে হবে, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেন এখানকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

মামুনুর রশীদ, সাংবাদিক