সাধুসঙ্গ থেকে লালন মেলা

ছেঁউড়িয়া গ্রামটি লালন সাঁইয়ের আখড়াবাড়ি ও সমাধিস্থল হিসেবে সারা দেশের মানুষের কাছে যেমন তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে, তেমনি বহু দেশের গবেষক ও পর্যটকের আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল এই গ্রাম।

লালন প্রবর্তিত সাধুসঙ্গের প্রাচীন ধারাটি পরিবর্তিত হয়ে এখন রূপ লাভ করেছে লালন মেলায়
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সাধকশ্রেষ্ঠ লালন সাঁই (আনু. ১৭৭৪-১৮৯০)। এ দেশের গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্যিক ভাবধারার মিশ্রণে তিনি এমন এক জীবনবিধান ও দর্শন তাঁর রচিত গানের মাধ্যমে রেখে গেছেন, যা অদ্যাবধি প্রবহমান। তাঁর প্রবর্তিত জীবনাচার ও সংগীতের ধারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুসরণীয় ও গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যেই আমেরিকার বিখ্যাত গবেষক ক্যারোল সলোমনের গবেষণায় ও অনুবাদে সিটি অব মিররস: সংস অব লালন সাঁই (আরশিনগর: লালন সাঁইয়ের গান) নামে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (নিউইয়র্ক, আমেরিকা) থেকে দ্বিভাষিক (ইংরেজি ও বাংলা) বিশাল আকৃতির একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া, বহু দেশে চর্চিত হচ্ছে লালন সাঁইয়ের সংগীতের ঐতিহ্য। কিন্তু লালন সাঁইয়ের নামটি উচ্চারিত হলেই বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামের নামটি সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

ছেঁউড়িয়া গ্রামটি লালন সাঁইয়ের আখড়াবাড়ি ও সমাধিস্থল হিসেবে সারা দেশের মানুষের কাছে যেমন তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে, তেমনি বহু দেশের গবেষক ও পর্যটকের আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল এই গ্রাম। সেখানে সবাই শুধু লালনের সমাধি দেখতে বা সমাধিতে ভক্তি অর্পণ করতেই আসেন না, পাশাপাশি লালন সাঁইয়ের অনুসারীদের দর্শন, সঙ্গলাভ ও লালনসহ অন্য বাউল-সাধকদের গান শুনতেও এই গ্রামে বিহার করেন অনেকে। এর কারণ, লালন সাঁই জীবনের দীর্ঘ সময় এখানে অবস্থান করে, অনুসারী সাধক ও ভক্তদের সঙ্গে মিলে গড়ে তুলেছিলেন এই আখড়াবাড়ি।

অনেকের জানা আছে, এই আখড়াবাড়িতে লালনের আগমন, বসতি স্থাপন, বসবাস, সাধুসঙ্গ প্রভৃতি নিয়ে রয়েছে নানা রকম কিংবদন্তি।

ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়ি গড়ে তোলার সঠিক সময় ও ইতিহাস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে অনেক গবেষকের ভাষ্য থেকে এ কথা অনুমিত হয় যে লালন সাঁই ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের আগে বা পরে কোনো একসময় ছেঁউড়িয়া গ্রামে নিজের আখড়াবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। জানা যায়, লালন প্রতিষ্ঠিত আখড়াবাড়িতে একটি ঘরের দৈর্ঘ্য ছিল ২৫ হাত এবং প্রস্থ ছিল প্রায় ১৬ হাত। ঘরটির দুটি কামরায় লালন সাঁইয়ের শিষ্য ও ভক্তরা থাকতেন। লালন সাঁই নিজে যে ঘরে সাধন-ভজন করতেন, সেই ঘরকে বলা হতো ‘হকের ঘর’। লালনের এই হকের ঘর ছিল পুবদুয়ারি। খড়ের ছাউনিতে আচ্ছাদিত গোলাকৃতির ঘরের চারদিকে ছিল বারান্দা। লালনের ইচ্ছা অনুযায়ী, তিনি দেহ রাখার পর তাঁর শিষ্যরা ওই ঘরেই তাঁকে সমাহিত করেন। দীর্ঘদিন লালন সাঁইয়ের ভক্ত ও শিষ্যরা আদিভাবে লালনের সমাধি রক্ষার চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মাজারের অনুকরণে আজকের লালন সমাধিসৌধ গড়ে ওঠে।

লালন ছেঁউড়িয়ায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত আখড়াবাড়িতে প্রতিবছর দোলপূর্ণিমায় ‘সাধুসেবা’ বা ‘সাধুসঙ্গ’ করতেন। সেই দোলপূর্ণিমার সাধুসঙ্গে লালনের নির্দেশনা অনুযায়ী গুরুকর্ম, বাল্যসেবা, পূর্ণসেবা, অধিবাসের পাশাপাশি বিভিন্ন পর্বের গান তথা দৈন্যগান, গোষ্ঠগান, প্রবর্ত্তসহ নানাবিধ তত্ত্বগান পরিবেশিত হতো। পাশাপাশি লালনপন্থী ব্যক্তিদের সাধনপদ্ধতির বিভিন্ন দিক নিয়ে অনুষ্ঠিত হতো আলোচনা সভা। তা ছাড়া, নতুন ভক্তদের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হতো এবং সাধনায় সিদ্ধিপ্রাপ্তদের জন্য প্রদান করা হতো খেলাফত। লালন প্রবর্তিত সাধুসঙ্গের এই ধারা গুরু-শিষ্য পরম্পরা লালনপন্থী সাধক সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো চলমান। ছেঁউড়িয়ার লালন সাঁইয়ের সমাধিপ্রাঙ্গণ থেকে সাধুসঙ্গের সেই প্রাচীন ধারা পরিবর্তিত হয়ে লালন মেলায় রূপ লাভ করেছে।

১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর) লালনের তিরোধানের পরের বছর থেকে প্রতিবছর তাঁর তিরোধান স্মরণে ওই ১ কার্তিকে সাঁইজির আখড়াবাড়িতে নতুন আরেকটি সাধুসঙ্গ প্রবর্তিত হয়। এই সাধুসঙ্গে গুরুর জীবলীলাকে স্মরণ করে লালনপন্থী সাধকেরা সম্মিলিত হতেন। এখানে মূলত লালনকে স্মরণ করে তাঁর দেহগত অনুপস্থিতির জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশপূর্বক একধরনের শোক মিশ্রিত থাকত। পাশাপাশি প্রতিবছর ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়িতে তাঁর প্রবর্তিত এবং লালনের জীবদ্দশায় পালিত দোলপূর্ণিমার সাধুসঙ্গের উদ্‌যাপন তো ছিলই। এই দুই সাধুসঙ্গের নেতৃত্বের ভার ছিল লালনপন্থী সাধক সম্প্রদায়ের হাতে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে লালনপন্থী ব্যক্তিদের সাধুসঙ্গের ধারা তাঁর অনুগামীদের নির্দেশনামতে উদ্‌যাপিত হতে থাকে। পরে লালনের গানের প্রসার ও লালন গবেষণার উদ্দেশ্যে পদাধিকার বলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সভাপতি হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র’। মূলত এ সময় থেকেই ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে লালনপন্থী সাধকদের কর্তৃত্ব আস্তে আস্তে খর্ব হতে থাকে। ১৯৭৬ সালে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্রের নাম পরিবর্তিত হয়ে লালন একাডেমি হয়। ১৯৮৫ সালে এই একাডেমির তত্ত্বাবধানে লালন একাডেমি পাঠাগার এবং ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় লালন সংগীত বিদ্যালয়।

আসলে লালন একাডেমির তৎপরতায় ১৯৯০-এর দশকের সামান্য আগে বা পরে থেকে ছেঁউড়িয়া গ্রামে লালনের আখড়াবাড়িতে প্রতিবছরের অনুষ্ঠিত ১ কার্তিকে লালনের তিরোধান স্মরণের সাধুসঙ্গ ও লালন প্রবর্তিত দোলপূর্ণিমার সাধুসঙ্গ তার প্রাচীন রূপ পরিবর্তন করতে শুরু করে। কারণ, ছেঁউড়িয়ার লালনের আখড়াবাড়ির কর্তৃত্ব সম্পূর্ণভাবে লালন একাডেমির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার ফলে তা আর লালনপন্থী ব্যক্তিদের হাতে থাকে না। যদিও ১৯৬০-এর দশক থেকে বিভিন্ন সময় লালনপন্থী সাধকদের অনেকে ‘আখড়া কমিটি’, ‘লালন মাজার শরীফ কমিটি’ এবং ‘লালন মাজার শরীফ ও সেবা কমিটি’ নামে সংগঠিত হয়ে একাডেমির সমান্তরালে লালনপন্থী সাধকদের নিয়মে সাধুসঙ্গ পালন করার চেষ্টা করে আসছিলেন। কিন্তু লালনের অনুসারীদের মধ্যে বহু বিভেদ এবং তাঁদের তেমন কোনো সাংগঠনিক ও অর্থনৈতিক শক্তি না থাকায় ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে তাঁদের সেই সাধুসঙ্গ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন লালন একাডেমির আয়োজনে লালন সাঁইয়ের সমাধিকে কেন্দ্র করে সাধুসঙ্গের পরিবর্তে লালন মেলা হয়। শুধু তা–ই নয়, অনেক ক্ষেত্রে আখড়াবাড়িতে অনুষ্ঠিত লালন একাডেমির আয়োজনে ১ কার্তিক ও দোলপূর্ণিমার আয়োজনের নামের মধ্যেও ‘সাধুসঙ্গ’ কথাটি উল্লেখিত হতে দেখা যায় না।

লালনকে স্মরণ করতে পয়লা কার্তিক সাধুগুরুদের পাশাপাশি বিভিন্ন সাধু-ফকিরেরা গান করেন
ছবি: সংগৃহীত

লালন একাডেমি অনেক সময় লালন মেলার মূল আয়োজনে বিভিন্ন টেলিফোন কোম্পানি বা ব্যবসায়ী সংস্থার বিজ্ঞাপন প্রচারের শর্তে তাদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অনুদান বা পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে থাকে। এসব লালনের স্মরণোৎসবকেন্দ্রিক লালন মেলাকে অনেকটা বাণিজ্যিক চেহারা প্রদান করেছে।

বর্তমানে এই মেলার মূল আয়োজন চলে আখড়াবাড়ি থেকে একটু দূরের কালী নদী ভরাট করে গড়ে তোলা মঞ্চে। সেখানে সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। একই মঞ্চে বিশিষ্ট সংগীতশিল্পীদের পাশাপাশি নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের পরিবেশনায় পরিবেশিত হয় বাউলগান। সংগীত পরিবেশনের বেলায় চটুল নৃত্যভঙ্গি, বাদ্যের অতি ব্যবহার লক্ষণীয়। এ ক্ষেত্রে সাধুসঙ্গের সংগীত পরিবেশনার কোনো রীতিনীতি অনুসরণ করা হয় না। তাই একে যেকোনো নাগরিক মঞ্চের বাউল বা লোকগানের আসর বলে ভ্রম হতে পারে। অন্যদিকে লালন মেলাকে কেন্দ্র করে লোকশিল্পের বিভিন্ন সামগ্রী থেকে শুরু করে লোকবাদ্যযন্ত্র ও লোকখাদ্যের দোকান, কবিরাজি ওষুধের দোকান ইত্যাদি বসে। আগ্রহী ক্রেতারা সেসব দোকান ঘুরে চাহিদামতো সামগ্রী কেনেন। সেই সঙ্গে গ্রামীণ মেলার মতো একপাশে থাকে নাগরদোলা, মেলায় আসা শিশুরা তাতে চড়ে আনন্দ খুঁজে নেয়।

লালন সাঁইয়ের আখড়াবাড়িকে কেন্দ্র করে এই লালন মেলায় সাধুসঙ্গের প্রচলিত রীতি মানা হোক বা না হোক, তাতে অবশ্য সাধুগুরুদের কিছু যায় আসে না। তাঁরা পয়লা কার্তিক লালনকে স্মরণ করতে এবং দোলপূর্ণিমায় লালন প্রবর্তিত রীতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে লালনের আখড়ায় আসেন। আর এটাই হলো ছেঁউড়িয়া গ্রামের সাঁইজির আখড়াবাড়ির মূল সৌন্দর্য ও আকর্ষণ। তাই বলা চলে, প্রতিবছর পয়লা কার্তিক ও দোলপূর্ণিমায় লালনের আখড়ায় সাধুসঙ্গের প্রাচীন ভাবধারা ভিন্ন আবেগে প্রবাহিত হয়। কেননা, এই দুই সময়ে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লালনপন্থী সাধুগুরুদের পাশাপাশি বিভিন্ন সাধু-ফকিরেরা আখড়াবাড়ির যেকোনো স্থানে নিজের মতো অবস্থান নিয়ে, নিজস্ব ভাবে মত্ত হয়ে ধ্যান, আলোচনা ও গান করেন। অতএব, ছেঁউড়িয়ায় লালন সাঁইয়ের আখড়ায় সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা যুগল বন্ধনে সজীব ঐতিহ্য হয়ে আছে এবং থাকবে, এটা বলাই যায়। তবু সাধুসঙ্গের আশ মিটবে না সাধকের। তাই হয়তো লালনপন্থী সাধকেরা সাধুসঙ্গের প্রত্যাশায় বারবার গেয়ে ওঠেন, ‘আর কি বসো এমন সাধুর সাধবাজারে।’