সামনে শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পথ

.
.

বাংলাদেশের ওষুধশিল্প আজ অনেকটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে ওষুধ কোম্পানির মালিক, শিল্পের সঙ্গে জড়িত দক্ষ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতি ও সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায়। একসময় দেশের চাহিদা মেটাতে এই ওষুধ আগে আমদানি ও বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে শিল্পটি চাহিদার ৯৮ ভাগ ওষুধ দেশেই তৈরি করে, আর বাকি ২ ভাগ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। সেগুলো মূলত উচ্চপ্রযুক্তিনির্ভর ওষুধ। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রতিযোগিতামূলক দামে গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করতে পারায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত দেশসহ এখন ১৪৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। তবে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বায়োসিমিলার, ভ্যাকসিন ও ক্যানসারজাতীয় উচ্চপ্রযুক্তিনির্ভর ওষুধ প্রস্তুতের পাশাপাশি কিছু মেডিকেল ডিভাইসও তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।

ওষুধের বাজারের প্রবৃদ্ধি

বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, দেশীয় বাজারে ওষুধজাত পণ্যের বাজার ক্রমবর্ধমান ধারায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী যার যৌগিক বাৎসরিক বৃদ্ধির হার শতকরা ১৫ থেকে ১৬-এর মধ্যে। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের ওষুধের বাজার দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। অর্থাৎ ২০২২ ও ২০২৩ সালের দিকে এই বাজার ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে। তথ্যমতে, ২০১৪ সালে এর বাজার ছিল ১০,৫৮৬.৪ কোটি টাকা (বৃদ্ধির হার শতকরা ৮.৪৬ ভাগ), ২০১৫ সালে ১১,৯৫৪.৮ কোটি টাকা (বৃদ্ধির হার শতকরা ১২.৯২ ভাগ), ২০১৬ সালে ছিল ১৫,৬৪০.১ কোটি টাকা (বৃদ্ধির হার শতকরা ৩০.৮২ ভাগ), ২০১৭ সালে ছিল ১৮,৭৫৫.৬ কোটি টাকা (বৃদ্ধির হার শতকরা ১৯.৯২ ভাগ) এবং ২০১৮ সালে ছিল ২০,৫১১.৮ কোটি টাকা (বৃদ্ধির হার শতকরা ৯.৩৬ ভাগ)।

ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সূত্রমতে, বাংলাদেশে মোট ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৭৩টি। তার মধ্যে ২১৪টি কার্যকর আছে। তবে এই বাজারের মূল অবদান রাখছে তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তথ্য–পরিসংখ্যান অনুযায়ী তালিকা ১ থেকে ১০-এর মধ্যে অবস্থানকারী কোম্পানিগুলোর দখলে রয়েছে দেশীয় বাজারের প্রায় ৬৮ শতাংশ। পরের ১১ থেকে ২০-এর মধ্যে থাকা কোম্পানিগুলো বাজারের দখল রাখছে ১৮ শতাংশ এবং বাকি কোম্পানিগুলোর অবদান মাত্র ১১ শতাংশ।

রপ্তানিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাকশিল্পের পরপরই রয়েছে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের অবদান। আগেই বলেছি, প্রতিযোগিতামূলক দাম, গুণ ও মানসম্পন্ন হওয়ায় বাংলাদেশের ওষুধ এখন বিশ্বের বাজারে অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। জাতীয় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৯ অর্থবছরে এযাবৎ রপ্তানি ১৩.০ কোটি ডলার। গত বছরের তুলনায় এর প্রবৃদ্ধির হার ২৫.৬৫ শতাংশ। ২০১৫ সালে বিদেশে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮.২১১ কোটি ডলার (প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৩.০৪ শতাংশ), ২০১৬ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮.৯৮২ কোটি ডলার (প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯.৩৯ শতাংশ), ২০১৭ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৯.৬৬০ কোটি ডলার (প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৫৫ শতাংশ), ২০১৮ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১০.৩৪৬ কোটি ডলার (প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.১০ শতাংশ)।

বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো সাধারণত বিদেশের বাজারে তখনই রপ্তানি করতে পারে, যখন সে ওখানকার বাজারে অনুপ্রবেশের অনুমতি পায়। এ জন্য তাকে অনেক তথ্য ও নথি সরবরাহ করতে হয় সেই দেশের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে। আমাদের দেশে আগে রোগীদের নিরাপদ ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফার্মাকোভিজিলেন্সের কোনো প্রকার কার্যক্রম ছিল না। বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেকগুলো তথ্যের মধ্যে এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কারণ, আমাদের ওষুধ আমাদের জনগণের ওপর ব্যবহারের ফলে যেকোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না, সে তথ্য তাদের প্রদান করা অতীব জরুরি। বাংলাদেশে বিদেশি কোম্পানিগুলোতে ফার্মাকোভিজিলেন্সের কার্যক্রম তাদের মূল প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ মোতাবেক বাধ্যতামূলক। বর্তমানে আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো প্রায় সবাই, বিশেষ করে যারা তালিকায় প্রথম দিকে আছে এবং বিদেশে রপ্তানি করছে, তারা অবশ্যই এই তথ্য আমাদের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে নিয়মিতভাবে প্রদান করছে। আর একটি বিষয়ে আমরা এখনো প্রকৃত সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি, সেটা হলো ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিআরও)। আমাদের ক্লিনিক্যাল অংশে কিছুটা সক্ষমতা থাকলেও অ্যানালিটিক্যাল অংশে এখনো অনেক পিছিয়ে। অর্থাৎ রক্তে ওষুধের উপস্থিতি ও পরিমাণ নির্ণয়ে এখনো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারিনি।

আমাদের একটি জায়গায় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সেটি হচ্ছে, ওষুধের কাঁচামাল বা এপিআই। চাহিদার ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ২০০ একরের যে এপিআই পার্ক সরকার বিভিন্ন কোম্পানিকে বরাদ্দ দিয়েছে, সেখানে যদি কাঁচামাল উত্পাদন করা যেত, তাহলে কাঁচামাল আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা খরচ কমে যেত এবং উত্পাদিত কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ার ফলে ওষুধের দামও কম হতো। কিন্তু সেই সুবিধা আমরা গ্রহণ করতে পারছি না।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের পাশাপাশি ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন ভূমিকা পালন করছে। আধুনিক চিকিত্সাব্যবস্থার পাশাপাশি অলটারনেটিভ এই পদ্ধতিও প্রাথমিক চিকিত্সাব্যবস্থায় বিরাট ভূমিকা রাখছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে ইউনানি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৭২ এবং সেখানে নিবন্ধিত ওষুধের সংখ্যা রয়েছে ৬ হাজার ৬৩০, আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০১ এবং নিবন্ধিত ওষুধের সংখ্যা ৪ হাজার ১১০, হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪২টি এবং নিবন্ধিত ওষুধের সংখ্যা ২ হাজার ৪১৭। আর হারবাল ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩২ এবং সেখানে নিবন্ধিত ওষুধের সংখ্যা রয়েছে ৫৫০। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার প্রচেষ্টা রয়েছে অলটারনেটিভ এই চিকিত্সাপদ্ধতির উন্নতি সাধন করা। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও কোম্পানিগুলোর সদিচ্ছা না থাকার কারণে তারা প্রকৃতপক্ষে গুণ ও মানসম্পন্ন ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হারবাল ওষুধ দেশের জনগণকে সরবরাহ করতে পারছে না।

হোমিওপ্যাথিক ওষুধের একটা বিশেষ সুবিধা থাকায় কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার নিয়মকানুন ও বিধিনিষেধ মেনে চলতে পারছে। আর সেটি হচ্ছে বেশির ভাগ ওষুধই একক উপাদানে তৈরি। ফলে এর মান নিয়ন্ত্রণ খুব সহজে করা যাচ্ছে। তবে যেসব অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হারবাল ওষুধ প্রস্তুত করছে, তারা কিন্তু সবাই ওষুধের গুণ ও মান নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে। সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এখানে, যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক চিকিৎসায় অবদান রাখছে, তাদের প্রণোদনা দিয়ে এই পিছিয়ে পড়া চিকিৎসাপদ্ধতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় নিলে আমরা আশা করতেই পারি যে ২০৩০ সালের মধ্যে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হব। তবে জিডিপির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জনসাধারণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাবে ঠিকই কিন্তু মানুষের গড় আয়ের ব্যবধান বেড়ে যাবে বলেই অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন। এতে যারা গরিব, তারা আরও গরিব হবে। ফলে ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে গেলে তাদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার বিষয়টি ঝুঁকির মুখে পড়বে। সরকারকে তখন জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে খরচ বাড়াতে হবে।

যদি একনজরে দেখি, বর্তমানে ওষুধের দেশীয় বাজারের পরিমাণ ২০,৫১১.৮ কোটি টাকা, বাৎসরিক প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৬ শতাংশ, মোট বাজারের ৯০ শতাংশই দেশীয় কোম্পানির দখলে, শুধু ১০ শতাংশ বাজার বিদেশি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। দেশীয় চাহিদার ৯৮ ভাগ উৎপাদিত হচ্ছে দেশেই, এর মধ্যে বাজারজাতকৃত ৮০ ভাগ ওষুধই জেনেরিক ওষুধ এবং বাকি ২০ ভাগ ওষুধ পেটেন্ড করা। আর বর্তমানে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে ১৪৭টি দেশে। ২০১৬ সালে বিশ্বে শুধু পেটেন্ডেড করা ওষুধের বাজার রয়েছে ৬০ বিলিয়ন ডলারের। খুব শিগগির এই ওষুধগুলো পেটেন্ড থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তখন নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আমাদের মেধাস্বত্ববিষয়ক বিধিনিষেধ থেকে যে ছাড় দিয়েছে, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওই সব ওষুধের জেনেরিক ভার্সন তৈরি, বাজারজাত ও রপ্তানি করতে পারব।

তবে ২০৩৩ সালের পরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই ওষুধ কোম্পানিগুলোকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। এ জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোকে ওষুধবিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়ার যৌথ উদ্যোগে নতুন নতুন গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। আশার কথা হলো, বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে অনুমান করাই যায় যে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতি শুধু তৈরি পোশাকশিল্পের ওপরই নির্ভর থাকবে না।

ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার: (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের অধ্যাপক)