সারথিনামা বা ড্রাইভারের গল্প

অলকংরণ: তুলি
অলকংরণ: তুলি

চালককে বলা হয় সারথি। সারথি মানে ড্রাইভার। সারথিনামা মানে গাড়ি চালক বা ড্রাইভারের গল্প।
অনেক দিন হলো সে আমার গাড়ি চালায়। ১৭ বছর বোধ হয় হতে চলল।
আমাদের সহকর্মী সুমনা শারমীন একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার ড্রাইভার কেমন ড্রাইভার? আমি বলি, অসাধারণ!
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একদম ডাঁট নাই। কোরবানির গরু কিনে এনে লুঙ্গি পরে পুরো গরু এক ঘণ্টায় বানিয়ে ফেলে। গাছে উঠতে বলে গাছে ওঠে। বাজার করে দিতে বললে বাজার করে আনে। খেতে বললে খায়। না খেতে দিলে মাইন্ড করে না। ওর সব ভালো। শুধু একটা জিনিস খারাপ।
কী জিনিস?
ও গাড়িটা ভালো চালাতে পারে না।
শুনে সুমনা শারমীন মূর্ছা যান আর কী!
যা-ই হোক, ১৭ বছর সে টিকে গেছে। টিকে গেলেই ভালো।
একবার হলো কী আমরা সবাই গেছি কক্সবাজার। পুরো প্রথম আলো পরিবার। স্পেশাল বিমানে করে এসেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা (প্রয়াত) বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান থেকে শুরু করে অভিনেত্রী বিপাশা হায়াত পর্যন্ত অনেক বিশিষ্টজন। শপথের অনুষ্ঠান। বদলে যাও, বদলে দাও। সারা বাংলাদেশে প্রথম আলো’র গাড়ি গেছে, শপথের গাড়ি, নাগরিকগণ শপথ করেছেন, কে কী ভালো কাজ করবেন, আমরা সেই শপথের ব্যানার প্রচার করব। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে আমরা ব্যানার ধরে দাঁড়াব। আর মঞ্চে দেশের বিশিষ্টজনেরা থাকবেন। তাঁরা শপথ বাক্য পাঠ করবেন। সেই শপথ একযোগে দেশের সব টেলিভিশন কেন্দ্র প্রচার করবে। আমি অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় হরফে সেই শপথ বাক্য ছাপা হয়েছে। বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে পুরো দেশ থমকে থাকবে। সবাই থাকবেন টিভির সামনে। সবাই শপথ নেবেন। আমরা দেশ গড়ব। নিজে বদলে যাব। দেশকে এগিয়ে নেব।
আমি মঞ্চে উঠেছি। দেশের বিশিষ্টজনেরা উঠেছেন। প্রথমে সম্পাদক মতিউর রহমান সাহেব দুটো কথা বলবেন।
অনুষ্ঠান শুরু করেছি। লাইভ। সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী মানুষ দেশের চ্যানেলগুলোর কারণে একযোগে অনুষ্ঠান দেখছে। সামনে সুনীল সাগর। সাদা ফেনা মাথায় নিয়ে একটার পর একটা তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে রুপালি সৈকতে। আকাশ সুনীল। মার্চের বালু তাতানো গরম। বাতাস বইছে। গাঙচিল উড়ছে সমবেত হাজারো মানুষের মাথার ওপরে।
আমি খুব উৎকণ্ঠিত। এত বড় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক আমি।
অনুষ্ঠান শুরু করলাম। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাহেব কিছু বলবেন। আমি ঘোষণা করলাম।
এই সময় ফোন বেজে উঠল।
অন্য কারও ফোন হলে ধরার প্রশ্নই আসে না। ড্রাইভারের ফোন। তার মানে কোনো দুর্ঘটনা। স্যার, গাড়ি তো মাইর খাইছে, নাইলে স্যার গাড়িতে তো পুলিশে আটকাইছে। ধরলাম, এই বলো তাড়াতাড়ি। আমি স্টেজে। লাইভ হচ্ছে। কী হয়েছে, তাড়াতাড়ি বলো।
স্যার, বিশাল ঘটনা। আপনেরে টেলিভিশনে দেখাইতেছে। আপনেরে টেলিভিশনে দেখি।
উফফ। কেমন লাগে।
কিছুদিন আগের কথা। আমার ড্রাইভার ফোন করল।
স্যার, আমি ফারমগেট দিয়া যাইতাছি, একলোক তারকাঁটার বেড়ার উপরে দিয়া আইসা আমার গাড়ির সামনে পড়ছে। উপরে ফুটওভারব্রিজ আছিল। সেইটাই না উইঠা তারকাঁটার বেড়া ডিঙায়া সে আমার গাড়ির উপরে পড়ছে।
সর্বনাশ। বেঁচে আছে তো?
হ্যাঁ, স্যার আছে। আমি তারে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাই?
পঙ্গুতে না। তুমি ডিএমসি নাও। আমি বলে দিচ্ছি...
না স্যার, সাথে লোক আছে। উনি বলতেছেন পঙ্গুতে নিতে।
আচ্ছা নাও।
একটু পরে ফোন। স্যার, পঙ্গু হাসপাতাল তো নেয় না। বলে ঢাকা মেডিক্যালে নিতে।
আমি বললাম, আমি বলছিলাম তোমারে? নাও।
আমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আমাদের প্রতিনিধি এবং আমার ডাক্তার ভাইকে ফোন করে সব রেডি করে রাখলাম।
বন্ধুসভার দুজন গিয়েও দাঁড়িয়ে থাকল।
আহত ব্যক্তির চিকিৎসা চলছে।
ড্রাইভারের ফোন। স্যার, টাকা লাগব।
বইমেলা চলছে। আমি বললাম, যাও অমুক প্রকাশকের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নাও। আমি বলে দিচ্ছি।
এক্স-রে হলো। সিটিস্ক্যান। না। আল্লাহর রহমতে হাত-পা কিছু ভাঙেনি। মস্তিষ্কের ভেতরে আঘাত নাই। আল্লাহ বাঁচালেন। ঘণ্টা দুয়েক চলে গেছে।
এরপর আবার ড্রাইভারের ফোন।
হ্যালো, বলো।
স্যার টেলিভিশন ক্যামেরা আইসা ভইরা গেছে। আমার ইন্টারভিউ চাইতাছে। আমি কি স্যার ইন্টারভিউ দিমু?
কী বলো?
আমি কি ইন্টারভিউ দিমু? টেলিভিশন ক্যামেরা আসছে স্যার। চ্যানেল আই, বাংলাভিশন। আপনি কয়া দিলেই স্যার অরা আমার ইন্টারভিউ নিব।
আমার গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু আমি আপনাদের জানাতে চাই কাহিনির এক নাম না-জানা চরিত্রের কথা। তিনি শিক্ষিত। আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন ভালো ইংরেজিতে। তিনি বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য আহত ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। অথচ তিনি এর আগে কোনো দিনও ওই আহত ব্যক্তিকে চিনতেন না। এই দেশে এ রকম পরোপকারী ভালো মানুষ এখনো অনেক আছেন। যাঁরা নিজেদের মূল্যবান সময় বিনিয়োগ করে নাম না-জানা বিপন্ন মানুষের সেবায় এগিয়ে আসেন। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কোথাও আগুন লাগলে পানি নিয়ে এগিয়ে যান। রানা প্লাজা ধসে পড়লে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে আহত চাপা পড়া মানুষকে উদ্ধার করেন। নিজের জীবন বিপন্ন করে ছিনতাইকারী কিংবা ঘাতক কিংবা নারী উত্ত্যক্তকারীকে ধাওয়া করেন।
আমি সেই ইংরেজি জানা পরোপকারী ব্যক্তিটিকে এই রচনার মাধ্যমে সালাম জানাই। তাঁর মাধ্যমে সালাম জানাই দেশের অসংখ্য ভালো মানুষকে, যাঁরা এখনো নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। তাঁদের জন্যই কবি লিখেছেন, ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ!
ও আচ্ছা, আমিও তো একবার সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলাম।
অবশ্য তখন আমি গাড়িতে ছিলাম না, ছিলাম সিএনজিচালিত ত্রিচক্রযানে।
মাথা ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরছিল।
আমার অ্যাকসিডেন্টের খবরে নিশ্চয়ই অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। তবে আমার জানামতে হাউমাউ করে একজনই কেঁদেছিল। সে আমার সেই অতিপুরাতন ড্রাইভার।