সুমা-সুমির স্বপ্ন

সুমা হতে চায় শিক্ষক আর সুমি এখনো ঠিক করেনি জীবনের লক্ষ্য। ছবি: আবদুস সালাম
সুমা হতে চায় শিক্ষক আর সুমি এখনো ঠিক করেনি জীবনের লক্ষ্য। ছবি: আবদুস সালাম

সাভার আড়াপাড়া বটতলার উত্তরে টিনের ছাপরার বস্তি। শ্যামল চন্দ্র মণি দাসের জং ধরা টিনের ঘর বস্তির প্রায় শেষ মাথায়। ঘরের দরজা বরাবর উল্টো দিকের দেয়ালে ঝুলছে শ্যামলের স্ত্রী, ববিতা মণি দাসের ফ্রেমে বাঁধা রঙিন ছবি। জন্মসাল কারও মনে নেই। মৃত্যু ২৪ এপ্রিল ২০১৩। রানা প্লাজা ধস।
দেয়াল থেকে মায়ের ছবিটি নামিয়ে মাঝখানে নিয়ে চৌকিতে বসল সুমা মণি দাস ও সুমি মণি দাস। সুমার বয়স এখন ১২ বছর আর সুমির ১১। দুই বোন সপ্তম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে স্থানীয় বিদ্যাকানন প্রিক্যাডেট অ্যান্ড হাইস্কুলে। ছোট ভাই সুমন চন্দ্র মণি দাস এ বছরই নার্সারিতে ভর্তি হয়েছে। একই স্কুলে। ওদের সবার বড় বোন সীমা মণি দাসের বিয়ে হয়েছে গত বছর।
দুর্ঘটনার ১৬ দিন পর পাওয়া গিয়েছিল ববিতার মরদেহ। অধর চন্দ্র স্কুলের মাঠে, আর ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে দিনের পর দিন স্ত্রীর মরদেহের জন্য ছুটেছেন শ্যামল।
ববিতা রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। একেবারে নিচের দিকে চাপা পড়ায় লাশ উদ্ধার করতেই অনেক দেরি হয়েছিল।
শ্যামল রিকশাভ্যান চালান। স্বামী–স্ত্রী দুজনের উপার্জনে বেশ চলছিল সংসার। ববিতার মৃত্যুতে ছন্দপতন হলো। সুমা-সুমি দুই মেয়ের পড়ালেখা নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন শ্যামল। এ সময় তঁাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে প্রথম আলো ট্রাস্ট। রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষাসহায়তার জন্য মেরিল–প্রথম আলো ট্রাস্ট সাভার সহায়তা তহবিলের একটি শিক্ষা বৃত্তি চালু আছে। প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত এই শিক্ষা বৃত্তি দেওয়া শুরু হয়েছে ২০১৪ সাল থেকে। প্রতি মাসে ট্রাস্টের এই শিক্ষা বৃত্তি পাচ্ছে সুমা-সুমি দুই বোন। শ্যামল বললেন, দুই বোনের স্কুলের বেতন, প্রাইভেট পড়া, খাতা-কলম, স্কুলের পোশাক—এসবের খরচ মেটানো একার আয়ে কঠিন হয়ে পড়েছিল। শিক্ষাবৃত্তি না পেলে হয়তো বন্ধই হয়ে যেত মেয়ে দুটোর পড়ালেখা।
লেখাপড়ায় সুমা-সুমির বেশ আগ্রহ। সুমা অন্তত স্নাতক পর্যন্ত পড়তে চায়। সম্ভব হলে আরও ওপরে। তার ইচ্ছা শিক্ষকতা করার। সুমির এ রকম নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য এখনো নেই।
মায়ের কথা ছোট ভাই সুমনের তেমন মনে পড়ে না। তবে সুমা-সুমির মনে প্রায়ই মায়ের মুখ ভেসে আসে। তখন আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। গলার ভেতর কী যেন দলা পাকিয়ে ওঠে। দুই বোন প্রায় একই সঙ্গে বলল, ‘মায়ের কথা কি কোনো দিন ভোলা যায়?’ তারপর চুপ। আসলে এ রকম মুহূর্তে বিশেষ কিছু বলারও থাকে না। যেন সব কথা ফুরিয়ে যায়।

এক নজরে
রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে দেশের আপামর জনসাধারণ। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় মেরিল-প্রথম আলো ট্রাস্ট সাভার সহায়তা তহবিলে মোট জমা পড়ে ২,২১,১৭,৯২২ টাকা। হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার কার্যক্রম, তাত্ক্ষণিক সহায়তা, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিকিত্সা, পুনর্বাসন, শিক্ষাবৃত্তি, যাতায়াত ও অন্যান্য কাজে ব্যয় করা হয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ ১৭ হাজার ৯২২ টাকা। তহবিলে বর্তমান জমা আছে ৫০ লাখ টাকা, যা দিয়ে রানা প্লাজায় নিহত পরিবারের ২০ জন শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার জন্য শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।