২০২২ সালের যেসব বড় চ্যালেঞ্জ

লন্ডন-দিনপঞ্জির বছর যখন সমাপ্তির পথে, তখন আগামী ১২ মাসে কী কী হবে এবং সেগুলো কে কতটা জানে তা নিয়ে ঘরের অন্দরে শব্দখেলা শুরু হয়েছে। অবশ্য ২০২২ এসে গেলে, পরে (এবং তারও পরে) সত্যিই যা যা হবে, তা অনুমানযোগ্য কি না, তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। আমি এমন কোনো সময়ের কথা মনে করতে পারি না যখন এত বেশি অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর এত বড় বড় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে ছিল।

আর্থিক বাজার বিষয়ে এ রকম গভীর অনিশ্চয়তা বিশেষভাবে কৌতূহলজনক। বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন নেতিবাচক মোড় নিলে আজকের উত্তুঙ্গ বাজারে তার পরিণতি হবে মারাত্মক।

কোভিড-১৯ ছাড়া সবচেয়ে জরুরি ও প্রাসঙ্গিক সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধানতম হলো মূল্যস্ফীতি। এই কয়েক বছরের মূল্যবৃদ্ধি কি সাময়িক নাকি তা আরও গুরুতর কোনো কিছুকে তুলে ধরছে? আমার বেকুবি উত্তর হলো, ‘আমি জানি না।’ যদিও গত বছরের এ রকম সময়ে আমি ধারণা দিয়েছিলাম, মূল্যস্ফীতি দুর্বল প্রবৃদ্ধির চেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠবে। এখন ২০২২ সালের দিকে তাকিয়ে আমি আগের চেয়ে অনেক কম নিশ্চিত।

অনেক দেশের অর্থনীতিতে চলমান মূল্যস্ফীতিজনিত চাপের বেশিটাকেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতির সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায়। তারপরও তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরবরাহে ঘাটতি এখনো বিদ্যমান। কিন্তু সরবরাহে ঘাটতির বিষয়টিও আরও বড় সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। যেমন বলা যায় অর্থনৈতিক অতি–প্রণোদনা, অকার্যকর আর্থিক নীতি, অথবা দুর্বল উৎপাদন প্রবৃদ্ধির কথা। এসবের কোন কোন উপাদান বেশি ক্রিয়াশীল এবং তা কোন মাত্রায়, সেটি নির্ভর করবে আর্থিক বাজারে এসবের প্রভাবের মাত্রার ওপর।

২০২২ সালের অন্য প্রশ্নগুলোও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জড়িত। যেমন আজকের অর্থনীতিতে আর্থিক নীতির উদ্দেশ্য আসলে কী হবে? আমাদের কি এখনো সরকারি ঋণের মাত্রা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা উচিত, নাকি আমরা (অপ্রত্যাশিত কায়দায়) আবিষ্কার করে ফেলেছি যে এ ব্যাপারে আমাদের কখনো উদ্বিগ্ন হওয়া দরকার ছিল না? আমি মোটামুটি খোলা মনের মানুষ, কিন্তু এই বিতর্ক নিয়ে আমার নির্দিষ্ট কিছু সংশয় রয়েছে।

আর্থিক নীতি ও বিশেষ অবস্থায় সরকারি ঋণের সমস্যা হয়ে পড়ার ধারণা বিষয়ে ২০২১-২২ সালের ঘটনাবলি দেখিয়েছে যে প্রচলিত চিন্তাভাবনার অনেকটাই ভুল ছিল। ঋণের চেয়ে বরং আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কেন ঋণ করা হচ্ছে? অর্থনৈতিক ধস ঠেকানোর জন্য ঋণ করা আর উচ্চাভিলাষী সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তহবিল জোগানোর জন্য করা ঋণ সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।

আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে মহামারির আগেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ২০০৮ সালের পরের দুনিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সীমাহীন উদারতা তার প্রয়োজনীয়তার চেয়ে বেশি দিন টিকে আছে। মূল্যস্ফীতি-সমন্বিত সুদের হারের সঙ্গে জিডিপির সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির হারের মধ্যকার সম্পর্কের দিকে অনেক আগেই আমাদের ফিরে যাওয়া দরকার ছিল।

কোভিড-১৯–এর মতো বড় ধরনের ধাক্কা সামলানোর জন্য সাময়িক বিরতির পক্ষে অজুহাত দেওয়া গেলেও অতিশিথিল আর্থিক নীতি চালিয়ে যাওয়া মনে হয় ভুল ছিল। মিল্টন ফ্রিডম্যানের অনুসারীরা এমনকি এ–ও বলে থাকেন, মূল্যস্ফীতির বর্তমান উল্লম্ফনের জন্য এসব নীতিমালা দায়ী। তাহলেও বছরের পর বছর ধরে উচ্চতর মূল্যস্ফীতির হার (তাদের ঘোষিত লক্ষ্যের কাছাকাছি কিংবা তারও বেশি) অর্জনের জন্য সংগ্রাম করার পর, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন মূল্যস্ফীতিকে সাময়িক বলে ভাবতে পছন্দ করছে।

বাস্তবে, মূল্যস্ফীতি চলমান থাকবে কি না, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে আমার বা আপনার চেয়ে ভালো কোনো ধারণা নেই। যদি এটাকে সাময়িক বলেও দেখা যায়, তারপরও উদার আর্থিক নীতির যৌক্তিকতা ক্রমশ সন্দেহজনক হয়ে উঠছে। কেননা, আর্থিক খাতের শর্তগুলো শিথিল করার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এই সন্দেহের পাল্লাই ভারী করছে যে আধুনিক পুঁজিবাদ আসলে সম্পদশালী কতিপয় মানুষের জন্যই সুফলদায়ক।

এদিকে নীরবে এসব সমস্যা ছাপিয়ে উঠছে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মূল প্রশ্নটা। অনেক বছর ধরে অগ্রসর অর্থনীতিগুলো এ বিষয়ে হতাশাজনক পরিস্থিতিতে রয়েছে। মহামারিজনিত আচরণগত পরিবর্তন ও উদ্ভাবনগুলো কি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তুমুল উৎপাদনশীলতা অর্জনকে সূচিত করছে? এর উত্তরে আমি এক পা রাখব আশাবাদীদের শিবিরে। অংশত এ জন্যই আমি এমন ধারার আর্থিক প্রণোদনার দরকার দেখি না। কিন্তু গত দশকগুলোর টানা নিরাশাজনক অবস্থার পর, আমি দুটি পা-ই ওই শিবিরে রাখার ভরসা পাই না। সব সময়ের মতোই নীতিনির্ধারকেরা এই অভিপ্রায় জারি রেখেছেন যে কীভাবে প্রবৃদ্ধি আরও জোরদার করা যায়। আমরা আশা করতে পারি, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তাঁরা এ ব্যাপারে এখন বেশি যত্নশীল হবেন।

এসব সমস্যা এবং অজ্ঞাত পরিস্থিতিগুলো যেন যথেষ্ট প্যাঁচে ফেলেনি, এর বাইরে অপ্রচলিত বড়মাত্রিক সমস্যার দীর্ঘ তালিকা রয়েছে, যা বিবেচনা করা দরকার। ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা চীনা অর্থনীতি বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে কতটা সমন্বিত হতে পারে, তা এখনো দেখার বিষয়। মহামারি আর কী কী চমক আনবে তা কেবল অনুমানই করা যেতে পারে। অমিক্রন কি দ্রুতই নতুন দাপুটে সংস্করণ হয়ে উঠবে, নাকি তা নতুন কোনো একটি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হবে? অন্যান্য বড় হুমকিরই বা কী হবে, যেমন অ্যান্টি–মাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্সের সুপ্ত মহামারি অথবা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত হুমকিগুলো?

বৈশ্বিক দারিদ্র্যও আরেকটি বড় সমস্যা, গত দুই বছরে আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। জ্বালানি রূপান্তরের চেয়েও এটা দূর করা আরও বড় সমস্যা হয়ে উঠবে। পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তাতে সাবেকি ভোটার এবং স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা বারবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সহ্য করবে না। এমনকি আরও পরিষ্কার জ্বালানির দিকে যাত্রার জন্য তা জরুরি হলেও। জ্বালানি রূপান্তরের চেয়েও দারিদ্র্য দূর করা আরও বড় সমস্যা হয়ে উঠবে। নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়টি নিয়ে আরও সৃষ্টিশীলভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার।

চূড়ান্তভাবে, বৈশ্বিক সুশাসন বিষয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ২০০৮-১০ মেয়াদে যখন জি–২০ অনেক কার্যকর ছিল, তার চেয়ে ২০২০-২১ মেয়াদে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার বেলায় কোনো অর্থবহ অগ্রগতি হয়নি। আশা করতে পারি, ২০২২ সালে এই ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি বয়ে আনবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জিম ও’নেইল যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও গোল্ডম্যান সাকস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান