আবারও সেই কোহলি-মহিমা!

বিরাট কোহলির হাফ সেঞ্চুরি উদ্যাপনটাকে কেউ ম্যাচ জয়ের উদ্যাপন ভেবে ভুল করতেই পারতেন। ‘ভুল’ই বা বলেন কীভাবে! ভারত তো তখন ম্যাচ জিতেই গেছে। ২১ বলে দরকার ১৪ রান, হাতে ৬ উইকেট—অনিশ্চয়তার ছায়াও তখন ইডেন থেকে এক শ কিলোমিটার দূরে।
দিন বিশেকের ব্যবধানে আবারও ভারত-পাকিস্তান। আবারও সেই একই গল্প। মিরপুরই যেন ফিরে এল ইডেনে। এশিয়া কাপে ভারত ৩ উইকেটে ৮ হয়ে যাওয়ার পর বিরাট কোহলির অপরাজিত ৪৯ রানের দারুণ ওই ইনিংস। যে উইকেটে অন্য সব ব্যাটসম্যান ব্যাটিংকে বিশ্বের কঠিনতম কাজ মনে করিয়েছেন, সেখানেই কোহলি আশ্চর্য সাবলীল।
শুধু ৬ রান বেশি করেছেন বলেই নয়, ইডেনের ইনিংসটা আরও ‘বিরাট’ মহিমা নিয়ে দেখা দিচ্ছে। বিশ্বকাপের ম্যাচ, যেটিতে হারলেই বিদায়। এর সঙ্গে যোগ করে নিন ভারত-পাকিস্তানের চিরন্তন সেই অসহনীয় চাপ। যেটি আরও শতগুণ হয়ে গেল পঞ্চম ওভারেই স্কোর ৩ উইকেটে ২৩ রান হয়ে যাওয়ায়। সেখান থেকে ম্যাচটা অবলীলায় বের করে নিলেন বিরাট কোহলি। এমন অনায়াস ভঙ্গিতে যেন জানতেন, শেষ পর্যন্ত তিনিই জিতবেন।
কদিন আগেই তামিম ইকবাল বলছিলেন, টি-টোয়েন্টিতে তাঁর দলে যদি একজন ব্যাটসম্যানকে নিতে হয়, সেটি হবেন কোহলি। শুনে একটু অবাকই লেগেছিল। টি-টোয়েন্টি বললেই যেমন ধুমধাম মারের কথা মনে পড়ে, কোহলি তো তেমন নন। কোহলি আবারও বুঝিয়ে দিলেন, টি-টোয়েন্টিটা শুধু ক্রিস গেইলের মতোই খেলতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। ক্রিকেটিং শট খেলেও সেটিতে রান করা যায়। ম্যাচও জেতানো যায়।
জেতানোর প্রসঙ্গ উঠলে বিরাট কোহলি আরও ‘বিরাট’ হয়ে যাচ্ছেন। এই ম্যাচের আগে তাড়া করতে নেমে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৭৮.১০। কালকের ৩৭ বলে অপরাজিত ৫৫ সেই গড় আরও অবিশ্বাস্য করে দিল। পরে ব্যাটিং করে এই নিয়ে অপরাজিত থাকলেন অষ্টমবারের মতো। তাড়া করতে নেমে এটি তাঁর নবম হাফ সেঞ্চুরি।
মিরপুরে যেমন হয়েছিল, এখানেও কোহলির ইনিংসটাই পার্থক্য গড়ে দিল দুই দলের মধ্যে। ক্রিকেটের অনন্ত সেই রহস্যেও যোগ হলো আরেকটি অধ্যায়। বিশ্বকাপে ভারতকে হারাতে পারে না পাকিস্তান। তা সেটি ৫০ ওভারের খেলাই হোক বা ২০ ওভারের। কালকের ম্যাচটি অবশ্য টোয়েন্টি-টোয়েন্টি থেকে ‘এইটিন-এইটিন’ করে দিয়েছিল বৃষ্টি।
যেটি শুরু হতেই বাকি সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনার বিষয় হয়ে গেল উইকেট। দ্বিতীয় ওভারে বোলিংয়ে এসেই রবিচন্দ্রন অশ্বিন এমনভাবে বল ঘোরাতে শুরু করলেন যে, বিস্ময় জাগল খেলাটা ইডেনেই হচ্ছে তো! এই মাঠে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে উইকেট ছিল ব্যাটিং-স্বর্গ। পরদিন শ্রীলঙ্কা-আফগানিস্তান ম্যাচেও সেটি এমন কিছু বদলায়নি। অথচ কাল ইডেনের উইকেট যেন নাগপুরে ভারতের প্রথম ম্যাচের চেহারায়। বিস্মিত ব্রায়ান লারা টুইট করলেন, ‘একই মাঠে একটা উইকেট আরেকটি উইকেট থেকে কীভাবে এতটা ভিন্ন হয়!’
সেই প্রশ্নের উত্তর কিউরেটর দিতে পারবেন। নাগপুরের ওই অভিজ্ঞতার পর ভারতীয় দল টার্নিং ট্র্যাকের অর্ডার দিয়েছিল, এটা ভাবতেও একটু অবিশ্বাস্য লাগে। সেখানে মাত্র ১২৬ রান তাড়া করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভারত। সেদিন আর এদিনের পার্থক্য হিসাবে আবারও আসছেন সেই বিরাট কোহলি। ম্যাচ শেষে যিনি নিজেই বললেন, ওই দিন তিনি আউট হয়ে যাওয়াতেই সর্বনাশটা হয়েছে। ও সময় আউট হওয়াটা একটুও উচিত হয়নি।
নাগপুর থেকে শিখেছেন কোহলি। ভারতের অন্য ব্যাটসম্যানরা শিখেছেন কি না, সেটি অবশ্য বোঝা যাচ্ছিল না। আমিরকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট রোহিত শর্মা। ১৪ রানে প্রথম উইকেট, ম্যাচ তাহলে জমছে। সেটি আসলে জমিয়ে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ সামি।
এই ম্যাচের আগে মোহাম্মদ আমির নাকি ইডেনে শোয়েব আখতারের ওই দুটি বলের ভিডিও দেখছিলেন। ১৯৯৯ এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে শোয়েবের পরপর দুই ইয়র্কারে দ্রাবিড় ও টেন্ডুলকারের স্টাম্প উড়ে যাওয়া ক্রিকেটের অমর এক ছবি হয়ে আছে। মাঠে অবশ্য আমির নয়, ‘শোয়েব’ হয়ে গেলেন মোহাম্মদ সামি। ইমাদ ওয়াসিমকে বাদ দিয়ে তাঁকে দলে নেওয়া নিয়েই প্রশ্ন ছিল। উইকেট এমন স্পিনবান্ধব হিসেবে দেখা দেওয়ার পর তো আরও। সেই সামিই পরপর দুই বলে ধাওয়ান ও রায়নাকে বোল্ড করে স্তব্ধ করে দিলেন ইডেনের ৬৭ হাজার দর্শককে। সতেরো বছর আগে যেমন দিয়েছিলেন শোয়েব আখতার।
তাঁদেরকে আবার মুখর করে তোলার কাজটায় কোহলির সঙ্গে যোগ্য সংগত যুবরাজ সিংয়ের। চতুর্থ উইকেটে দুজনের ৬১ রানের জুটি। ওয়াহাব রিয়াজকে মারা ছক্কায় যুবরাজ মনে করিয়ে দিলেন সেই স্বর্ণালি সময়কে। আর কোহলির ইনিংসের ৭টি চার ও ১টি ছয়ের প্রতিটিই যেন কোচিং ম্যানুয়ালের ছবি। টি-টোয়েন্টিতে কারও ব্যাটিং নিয়ে এমন বলতে পারার অর্থ সেই ব্যাটসম্যান বিশেষ কিছু।
তা বিরাট কোহলি তো বিশেষ কিছুই। স্পেশাল!

পাকিস্তান: ১৮ ওভারে ১১৮/৫
ভারত: ১৫.৫ ওভারে ১১৯/৪
ফল: ভারত ৬ উইকেটে জয়ী