আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ চিনিয়েছিলেন যিনি

একটা দৃশ্য কল্পনা করা যাক। ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ়ের পাশে গোল হয়ে বসে আছে তাঁর নাতিপুতিরা। ২০১৪ সালে বসে সেই তিনি ফিরে গেলেন ৩৬ বছর আগে, ‘আরে তোরা যে এত মেসি, মেসি করিস, এই মেসির আর্জেন্টিনাকে প্রথম বিশ্বকাপ জিতিয়েছে কে? উঁহু, যা ভাবছিস, ম্যারাডোনা নয় কিন্তু। বিশ্বকাপ বলে যে একটা বস্তু আছে, সেটি সত্যিকারভাবে আর্জেন্টিনা চিনেছিল সিজার লুইস মেনোত্তির সৌজন্যে।’
বলতে বলতেই ঘোরলাগা চোখে বৃদ্ধ স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠলেন। সেই ধোপদুরস্ত স্যুট-টাই পরা একহারা গড়ন। চুল নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত। একটু পর পর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন। ডাগ-আউটে কখনো উদ্বিগ্ন, কখনো চিৎকার করে কী যেন বলছেন ছাত্রদের। মুখে কিছু না বললেও হাবভাবেই যেন বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘এই দলটা আমার।’ দলটা মেনোত্তিরই ছিল বটে!
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, আশির দশক প্রায় আসি আসি করছে। আর্জেন্টিনায় তখন ভীষণ অস্থিতিশীল অবস্থা। সামরিক জান্তা বছর দুয়েক আগে ক্ষমতা দখল করেছে৷ দেশজুড়ে অসন্তোষের চাপা গর্জন। বেশ কয়েকটি দল ১৯৭৮ আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ বর্জন করতে পারে, এমন ফিসফাসও উঠে গেল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সব কটা দলই এসেছিল বিশ্বকাপে।
আর্জেন্টিনার সেই বিশ্বকাপ জেতাটা বড্ড দরকার ছিল। কোপা আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব এর মধ্যে অনেকবারই পাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ফিফা বিশ্বকাপটা তখনো অধরা। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই আর্জেন্টিনাজুড়ে একটা ধ্বনি, ‘এখন, নয়তো কখনোই নয়।’
টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই প্রথম চমকটা উপহার দিলেন সিজার মেনোত্তি। দায়িত্ব নিয়েছিলেন বছর চারেক আগে, ধীরে ধীরে বদলে ফেলেন দলের খোলনলচেই। রিভার প্লেট ও বোকা জুনিয়র্সের অনেক খেলোয়াড়কে বাদ দিয়ে দেন। সেই পরিস্থিতিতে সেটা ছিল ভীষণ সাহসী সিদ্ধান্ত। তবে বিশ্বকাপ শুরুর আগে যেটা করলেন, সেটা সাহস না বোকামি সেই প্রশ্ন উঠে গেল। তখন আর্জেন্টিনা ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামে ১৭ বছরের এক তরুণ তুর্কিতে বুঁদ। সেই বিস্ময়কে ২৫ জনের প্রাথমিক দলেও রেখেছিলেন মেনোত্তি। কিন্তু ২২ জনের দল ঘোষণার পর দেখা গেল, ম্যারাডোনা নেই সেখানে! ব্যস, শুরু হয়ে গেল কোচের মুণ্ডুপাত। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপটা দর্শক হয়েই দেখেছিলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু মজার ব্যাপার, শেষ পর্যন্ত শেষ হাসিটা হেসেছিলেন মেনোত্তিই।
টুর্নামেন্টের শুরুটাও খুব মসৃণ হয়নি আর্জেন্টিনার। হাঙ্গেরি ও ফ্রান্সকে হারালেও মন ভরাতে পারেনি সমর্থকদের। এরপর ইতালির কাছে তো হেরেই গেল। পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডের শুরুটা অবশ্য ভালোই হলো। ব্রাজিলের সঙ্গে ড্র করার শেষ ম্যাচের আগে সমীকরণ দাঁড়াল, ফাইনালে যেতে হলে অন্তত চার গোলের ব্যবধানে পেরুকে হারাতে হবে। আর্জেন্টিনা হারিয়েছিল ৬-০ গোলে।
সেই ম্যাচে পেছনের দরজা দিয়ে কিছু হয়েছিল কি না, সেটা এখনো রহস্যে ঢাকা। তবে স্বাগতিকেরা নিজেদের সেরাটা জমিয়ে রেখেছিল ফাইনালের জন্য। হল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কাপ জিতল কেম্পেস, প্যাসারেলাদের আর্জেন্টিনা। মেনোত্তি পরে জানিয়েছেন, শিরোপা জিতলে বুয়েনস এইরেসের প্রাণকেন্দ্র ওবেলিস্কে গিয়ে উদ্যাপন করবেন পণ করেছিলেন। মেনোত্তি তাঁর কথা রেখেছিলেন, ফাইনালের পর ছদ্মবেশে মিশে গিয়েছিলেন জনারণ্যের উৎসবে।
পরে বার্সেলোনা, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, রিভার প্লেট, বোকা জুনিয়র্সের কোচিং করিয়েছেন। দায়িত্ব নিয়েছিলেন মেক্সিকোরও। কিন্তু মেনোত্তিকে ইতিহাস মনে রাখবে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ চেনানোর জন্যই।
সমকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর ছিল তুমুল আগ্রহ। বিশ্বাস করতেন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে। ফুটবলে তাঁর দর্শন ছিল উপভোগের। আর্জেন্টিনার ফুটবল দর্শনে দুটি ভাগ, একদলের কাছে ফল মুখ্য, পরের দলের কাছে ফলের আগে সুন্দর ফুটবল। এই দলের অনুসারীদের কী বলা হয় জানেন? মেনোত্তিস্তা। সেই যে উপভোগের মন্ত্র জপে গিয়েছিলেন, ম্যারাডোনা থেকে শুরু করে আজকের মেসিদের ধমনিতে বইছে তাঁরই রক্ত!