এমন চরিত্র কোথায় পাবেন!

খেলা পাগল মনসুর। ছবি: প্রথম আলো
খেলা পাগল মনসুর। ছবি: প্রথম আলো

কথাবার্তায় মিশে থাকে অদ্ভুত এক সারল্য। হয়তোবা এ কারণেই ৫০ বছরের জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির জটিল হিসাবের খাতা খুলতে রাজি নন। খেলায় খেলায় সারাবেলা কাটিয়ে বিয়েটাও করা হয়নি এত দিনে। সেই ইচ্ছেটাও মরে গেছে। নিজেই বলেন, ‘বিয়ে করার সময় কই। এই খেলা...ওই খেলা।’ এভাবেই খেলার দুনিয়ায় নিজেকে উৎসর্গ করে মনসুর আলী হয়ে উঠছেন ব্যতিক্রমী এক চরিত্র।
খেলাটাই তাঁর নেশা। নেশার টানে ঘুরে বেড়ান এখানে–সেখানে। কখনো গ্রামের মেঠো পথে, কখনো জেলার কোনো এক স্টেডিয়ামে। কোনো খেলোয়াড়কে মনে ধরলে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ‘এরপর নিজের দলে রাখি বা কোনো কর্মকর্তার হাতে পায়ে ধরে অন্য ক্লাবে হয়তো ঢুকিয়ে দিই’—বললেন মনসুর। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন ‘খেলার ফেরিওয়ালা’।
১৯৮৭ সালে নিজের নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব, যা এখন বড় হয়েছে। মনসুরের ভিজিটিং কার্ডে আছে সেটার বর্ণনা। গর্বিত কণ্ঠে বলেন, ‘এখন তো ছয়টি আইটেম চালাই—ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল, টিটি, ব্যাডমিন্টন ও রাগবি।’
তবে ফুটবলই তাঁর প্রাণের খেলা। প্রাণের আনন্দে সংগঠকদের দুয়ারে দুয়ারে হাঁটেন স্পনসরের জন্য। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অভিজ্ঞতাই বেশি। সামান্য কিছু পাওয়া অর্থ–সহায়তা দিয়েই চলে সবকিছু। নিজেই বলেন, ‘প্রতিবছরই আমার টিমগুলোর রেজাল্ট ভালো’।
কিন্তু বাস্তবতা বলছে, প্রায় ৩০ বছর ধরে পাইওনিয়ার ফুটবল লিগে খেলছে মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব। দলটাকে ওপরে তুলতে নাকি ভয় পান, ‘পাইওনিয়ার লিগে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায় একটা দল গড়া যায়। কিন্তু তৃতীয় বিভাগে তুললেও আট-দশ লাখ টাকা লাগবে। এত টাকা আমাকে কে দেবে? তাই আমি দলটাকে পাইওনিয়ারেই রাখি।’
সেই রাখার পেছনে তাঁর সংগ্রাম অনেক। একটু প্রচারের আশায় স্টেডিয়াম এলাকায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে ঘোরেন। সাংবাদিক দেখলেই মিষ্টি হাসি আর ছোট একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিনয়ের সঙ্গে বাড়িয়ে দেন। অমুক জায়গায় মনসুর স্পোর্টিংয়ের জয়, অথবা মনসুর স্পোর্টিংয়ের খেলোয়াড় বাছাই...। ব্যস, এটুকুই।
কখনো সাড়া মেলে, কখনো না। মনসুর তুলে আনেন সেসব কথা, ‘অনেকে এখন প্রেস রিলিজ দেখলে ত্যক্ত-বিরক্ত হন। আমাকে দেখলেই বলেন, “মনসুর আইছে রে...। আবার প্রেস রিলিজ।” অনেকে সাগ্রহে বলেন, “তাড়াতাড়ি দ্যান।” সাংবাদিক ভাইয়েরা অনেক সাপোর্ট করেন। তাঁদের কারণেই আমি আসলে টিকে আছি।’
মনসুর টিকে আছেন, বিত্তবৈভব নেই তো কী! জীবনটাকে তিনি দেখেন মাঠ থেকে মাঠ দাবড়ে বেড়ানোর আনন্দের উপলক্ষ হিসেবে। ভালোবাসেন আবাহনী, আর্জেন্টিনা, মেসি। আর ভালোবাসেন পান খেতে। মুখটা তাই লাল হয়ে থাকে সারাক্ষণই।
সেসব বলতে গিয়ে সরল হাসিতে গড়াগড়ি খান, ‘একবার ক্রীড়া সাংবাদিক রুমি ভাই (প্রয়াত মাসুদ আহমেদ রুমি) মজা করে বললেন, “ওই, তুই এখনো বসে আছিস। কাবাডি তো স্বর্ণ পাইছে...।” আমি তাড়াতাড়ি প্রেস রিলিজ লিখে অভিনন্দন জানালাম কাবাডি দলকে। আসলে ওরা স্বর্ণ পায়নি। রুমি ভাই মজা করছিলেন। পরে বললেন, “তুই এটা কী করলি রে মনসুর!”’
স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের প্রয়াণের পর মনসুরের দেওয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি নিয়ে আজও মজা করেন অনেকে। সেবার লিখলেন, ‘এই বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠকের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।’ ব্র্যাডম্যান কবে ক্রীড়া সংগঠক হলেন! ‘আমি তো জানি না, হেয় মারা গেছেন। কে যেন বললেন, আমি শোক জানিয়ে প্রেস রিলিজ দিলাম। লিখলাম বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক’—আবারও তাঁর সরল হাসি।
খেলার নেশায় একসময় চাঁদপুরের বাড়িতে কম যাওয়া হতো। কৌশলে তাঁকে বাড়ি পাঠাতে কত মজার কাণ্ড! মনসুর বলে যান, ‘বন্ধুরা পত্রিকায় প্রেস রিলিজ দিল, আমার আব্বা-আম্মা নাকি মারা গেছেন। আমি বাড়ি গিয়ে দেখি তাঁরা সুস্থ, হা হা হা!’
লেখাপড়া ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। বেড়ে উঠেছেন পুরোনো ঢাকার সিদ্দিক বাজারে। ‘ওখানে হোটেল ছিল আমাদের, বড় ভাইয়ের সঙ্গে এগুলো চালাতাম। তখনকার সময় প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার টাকার পরোটা আর গরুর গোশত বিক্রি হতো। খাজা নূর হোটেল, জুতার দোকান..কত–কী ছিল!’ দীর্ঘশ্বাস মনসুরের।
বর্তমানে কাঁচা পণ্যের ব্যবসা করে জীবনের চাকা সচল রেখেছেন। আর প্রশিক্ষণ কর্মসূচিটি চালু রেখেছেন দনিয়া ধোলাইরপাড় মাঠে। এতেই তিনি সুখী, ‘আমি ভালো আছি, খুব ভালো।’
খেলার অঙ্গনে চরিত্রের কমতি নেই। তবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি হাতে নিয়ে ঘোরা এমন চরিত্র আর কোথায় পাবেন!