তাঁরা শ্যুটার, নাম শারমিন

গুলশান শ্যুটিং রেঞ্জে একই ফ্রেমে চার শারমিন। (বাঁ থেকে) পাবনার শারমিন আক্তার, চাঁদপুরের শারমিন, সিরাজগঞ্জের শারমিন ও মাগুরার শারমিন আক্তার রত্নাষ প্রথম আলো
গুলশান শ্যুটিং রেঞ্জে একই ফ্রেমে চার শারমিন। (বাঁ থেকে) পাবনার শারমিন আক্তার, চাঁদপুরের শারমিন, সিরাজগঞ্জের শারমিন ও মাগুরার শারমিন আক্তার রত্নাষ প্রথম আলো

সদ্যোজাত শিশুকে কোলে নিয়েই পাপিয়া আক্তার বলেছিলেন, ‘মা, এবার ছোট বোনের নাম আমি রাখব।’ মা-ও হেসে রাজি। পাঁচ বোনের ছোটটির নাম হলো শারমিন আক্তার। নামটি যে মেয়েদের শ্যুটিংয়ে ‘রোলমডেল’ হয়ে যাবে সেটা কি তখন জানতেন শারমিনের বড় বোন?
বাংলাদেশের শ্যুটিংয়ে বড় এক বিজ্ঞাপন শারমিন আক্তার। ২০০৪ ইসলামাবাদ এসএ গেমসে মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সোনা জিতে নামের ওজনটাই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপর শ্যুটিংয়ে আরও সাফল্য এসেছে। নিশানার বিন্দুগুলো ছুঁয়ে গেছে কোনো না কোনো শারমিনের সাফল্যের গুলি।
ঢাকায় ২০১০ এসএ গেমসে দলগত ও ব্যক্তিগত সোনা, দিল্লিতে কমনওয়েলথ শ্যুটিংয়ে সোনা, অথবা জাতীয় ও আন্তক্লাব শ্যুটিংয়ে সোনার পদক—কাকতালীয়ভাবে সব গেমসেই জড়িয়ে আছেন একজন করে শারমিন আক্তার!
একজন, দুজন নন, বাংলাদেশের শ্যুটিংয়ে বর্তমানে শারমিন আক্তার আছেন চারজন! শারমিন শিল্পা নামে আরেকজন এলেও এখন আর খেলেন না। বাকিরা যথেষ্টই আলো ছড়াচ্ছেন। শুরুটা করেছিলেন বিকেএসপির সাবেক ছাত্রী পাবনার ইছামতীপারের মেয়ে শারমিন (১)। এরপর মাগুরার শারমিন আক্তার রত্না (২)। তিনি জিতেছেন এসএ গেমস ও কমনওয়েলথ শ্যুটিংয়ে সোনা। সাভার সেনা শ্যুটিং ক্লাবের শারমিন আক্তার (৩) জাতীয় প্রতিযোগিতায় গত বছর জিতলেন রুপা, এবার বাংলাদেশ গেমসে ব্রোঞ্জ। সাফল্যের স্বীকৃতি পেলেন আগস্টে চীনের যুব এশিয়ান গেমসের বাংলাদেশ দলে সুযোগ পেয়ে। চীন-যাত্রায় সিরাজগঞ্জের এই শারমিনের সঙ্গী হন বিকেএসপির জুনিয়র শারমিন আক্তার (৪)। চাঁদপুরের শ্যুটার আন্তক্লাব ও জুনিয়রে চ্যাম্পিয়ন।
‘শারমিন নামটা লাকি’—গর্বের সঙ্গেই বললেন সিনিয়র শারমিন। যোগ করলেন, ‘এই নামে নতুন কেউ শ্যুটিংয়ে এলেই সবার মুখে শুনি, ও বাবা আরেকজন শারমিন এল! সবার প্রত্যাশা থাকে সেও হয়তো শ্যুটিংয়ে ভালো করবে।’
চার শারমিন একই সঙ্গে খেলছেন। অনুশীলন করছেন। নাম নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে এসব নিয়ে রত্নার বিড়ম্বনাটা একটু কম, ‘নাম নিয়ে যতটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে শারমিন আপুকে, আমার ততটা হয়নি। আমার নামের পাশে যে রত্না আছে।’ সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসে পরপর চার লেনে ছিলেন চারজন। তা দেখে অনেকেই মজা পেয়েছিলেন।
ভুল করে একজনের লেনে অন্যজনের অনুশীলনের ঘটনাও ঘটেছে। স্মৃতি হাতড়ে সেই গল্পটা বললেন রত্না, ‘পাঁচ বছর আগে প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলতে চীনে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে শারমিন আপুরও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একদিন আগে জানতে পারি, উনি যেতে পারবেন না। আমি ভেন্যুতে গিয়ে অনুশীলন শুরু করি। কিন্তু ওখানকার এক কর্মকর্তা বললেন এটা তোমার জায়গা না। পরে জেনেছি ওটা ছিল শারমিন আপুর জন্য বরাদ্দ। পরে নিজের লেনে গিয়ে প্র্যাকটিস করলাম।’
নামবিভ্রাটে বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন জুনিয়র দুই শারমিনও। গত আগস্টে যুব এশিয়ান গেমসে যাওয়ার আগে বিমানের টিকিট হাতে নিয়ে দুজনই যাঁর যাঁর আসনে বসলেন। কিন্তু দেখা গেল একজনের হাতে দেওয়া হয়েছে অন্য শারমিনের টিকিট। আসন নম্বর দেখে বসতে যাওয়ার সময় বোঝা গেল টিকিট বদল হয়ে গেছে! পরে জন্মতারিখ দেখে নিজেদের আসনে বসেন।
বাংলাদেশ গেমসে সাভার সেনা শ্যুটিং ক্লাবের শারমিনকে সিনিয়র ভেবে একজন তর্কই জুড়ে দিলেন। মজার সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন শারমিন, ‘শ্যুটিং রেঞ্জের ডরমিটরিতে ঘুরছিলাম, হঠাৎ একজন এসে বললেন, শারমিন তুমি আমাকে চিনলে না? আমি বললাম, আমি তো আপনাকে চিনি না। আপনি আমাকে কীভাবে চিনলেন? ভুল হয়েছে, বুঝতে পেরে পরে স্যরি বলেন ওই ভদ্রলোক।’
গত অলিম্পিকে সিনিয়র শারমিন ও রত্না একসঙ্গে লন্ডনে ছিলেন। দুজনের ঘনিষ্ঠতার শুরু তখন থেকেই। রত্নার প্রসঙ্গ তুলতেই শারমিন বললেন, ‘ও সারাক্ষণ কথা বলে। খুব মিশুক। আমরা দুজন ভালো বন্ধু।’ শারমিনরা বাংলাদেশের শ্যুটিংয়ের গৌরব—এটা ভাবতেই ভালো লাগে রত্নার, ‘এটা ঠিক যে নিজেদের প্রমাণ করতে পেরেছি।’
অথচ মজাটা হলো, শ্যুটিংয়ে আসার আগে তিনজনের কেউই জানতেন না, শারমিন নামের শ্যুটার আছেন ফেডারেশনে। এই নামের সঙ্গে কোথায় যেন মিশে আছে সৌভাগ্যের ছোঁয়া। বিকেএসপির জুনিয়র শারমিন সেটাই বললেন, ‘আপুদের দেখে মনে হয় আমার নামটা আসলেই লাকি।’