পরাজয়ে ডরে না বীর

আপনারা আজ পড়তে চান ফাইনালের খবর। আর্জেন্টিনা যদি জিতে যায়, মেসির হাতে ওঠে যদি সোনার কাপ, তাহলে বাংলাদেশ এখন বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। আর যদি তা না ঘটে থাকে, ফিলিপ লাম যদি ট্রফি উঁচিয়ে ধরেন, তাহলে ইশ্, একটুর জন্য বলে মাথা চাপড়াবেন কেউ কেউ, আর ব্রাজিল সমর্থকেরা অন্যের মুখে ঝাল খাওয়ার স্বাদ পাবেন।
গতকালের লেখায় কথা দিয়েছিলাম, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচটার পরিবেশের বর্ণনা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। সেই কথা এবার রাখতে হয়।
ব্রাসিলিয়ার এই জাতীয় স্টেডিয়াম, তার সঙ্গে গারিঞ্চার নামটাও যুক্ত আছে, পরিকল্পিতভাবে বানানো রাজধানী ব্রাসিলিয়ার মধ্যভাগে। চারদিকে যোজন যোজন জায়গা ফাঁকা রাখা। সবগুলো হোটেল থেকেই হাঁটাদূরত্ব। পাশেই টেলিভিশনের জন্য নির্মিত এক সুউচ্চ টাওয়ার, সুশোভন ফোয়ারা। সেমিফাইনালে ব্রাজিল যে ৭ গোল খেয়েছে, হলুদ-সবুজ জার্সি পরা সমর্থকদের উচ্ছ্বাস দেখে তা মনেই হলো না। তারা আগেভাগেই স্টেডিয়ামে এসে হাজির।
গান গাইছে, হইচই করছে, বাজনার তালে তালে নাচছে। স্টেডিয়ামের ভেতরে-বাইরে একেবারে জমজমাট অবস্থা। জাতীয় সংগীতের সময়ে, বা বড় পর্দায় নেইমারকে দেখানো হলে, পুরো স্টেডিয়াম এমন চিৎকার করে উঠছে, যে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। দুই গোল খেয়ে ফেলার পরও সমর্থকদের উৎসাহে ঘাটতি নেই।
আমার পাশে ছিলেন লরেন্সিক, বছর তিরিশের এক ব্রাজিলিয়ান, পানি বিভাগে আইটির কাজ করেন। তিনি বললেন, আমি চাই আজ ব্রাজিল হারুক, তা না হলে স্কলারিকে কোচ রেখেই দেবে।
মনে হচ্ছে ব্রাজিলিয়ানরা বলির পাঁঠা করতে চাইছে ফেলিপে স্কলারিকেই। তাঁকে পর্দায় দেখানোমাত্রই সমস্বরে চিৎকার, বু...।
তিন নম্বর গোলটা হওয়ার পর সবাই মিলে হল্যান্ডকে অভিনন্দন জানাল হাততালি দিয়ে। এটা কেবল হতাশা থেকে নয়, আন্তরিকতা থেকেই। কারণ খেলা শেষেও বেশির ভাগ দর্শক গ্যালারি ছেড়ে গেল না। তারা হল্যান্ডের পুরস্কার গ্রহণের দৃশ্য দেখল। আর হল্যান্ড যখন মঞ্চে উঠল, সব দর্শক দাঁড়িয়ে তাঁদের অভিনন্দিত করল।
মাত্র দুই ম্যাচে ১০ গোল খাওয়া স্বাগতিক দেশের দর্শকেরা এত ভালো! পরাজয়ে ডরে না বীর—কথাটা হয়তো এদের জন্যই প্রযোজ্য।
আমার মনে হয়েছে, ব্রাজিল এবার আসলেই খুব খারাপ একটা দলই ছিল। সেমিফাইনালের আগে তারাও তো কোনো বড় দলকে মোকাবিলা করেনি। যেটা স্পেন বা পর্তুগালকে করতে হয়েছে। তেমন কোনো গ্রুপে পড়লে ব্রাজিলও হয়তো প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিত। কিন্তু কী হলে কী হতো, এটা বলে লাভ নেই। কী হতো, যদি নেইমার থাকতেন, সিলভা থাকতেন। ‘যদি’, ‘কিন্তু’ দিয়ে জগৎ চলে না। জগৎ চলে ঘটে যাওয়া বাস্তবতা দিয়ে।
ব্রাজিলের গ্যালারিতে বসে ব্রাজিলের খেলা দেখার অভিজ্ঞতাটা অনেকটা বাংলাদেশের স্টেডিয়ামে বসে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দেখার মতো হলো। কিন্তু ব্রাজিলিয়ানদের আচরণে কোনো মালিন্য দেখলাম না। তারা ব্যানার উঁচিয়ে ধরল, ২০১৮ বিশ্বকাপে হবে।
গারিঞ্চা স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আসছি। চাঁদটাকে এত বড় আর এত কাছে দেখে থমকে দাঁড়ালাম। ব্রাসিলিয়া শহরটাকেও এরা এত সুন্দর করে বানিয়েছে। বাংলাদেশের আকাশেও কি গত রাতে এমনি চাঁদ উঠেছিল। পৃথিবীর সব মানুষ কি একই চাঁদের নিচে থাকে? একই রকম আলো পায়? সূর্য কিন্তু সারা পৃথিবীতে একই রকমভাবে আলো দেয় না।
তবে সারা পৃথিবীর মানুষকে একটা গোল বস্তু একই নেশায় মত্ত করে তুলতে পারে। তার নাম ফুটবল।
শেষ পর্যন্ত ফুটবল একটা খেলাই। খেলার মূল উদ্দেশ্য নির্দোষ বিনোদন এবং শরীরচর্চা। জয়-পরাজয় তো খেলারই অংশ। একই সঙ্গে ৩২টা দেশ চ্যাম্পিয়ন হবে না, একটা দেশ হবে, ৩১টাই হবে না। আমাদের পরাজয় মেনে নিতে শিখতে হবে। আমাদের জয় উদ্যাপনও শিখতে হবে। ফুটবল আমাদের সেই শিক্ষাটাই হয়তো দেয়। আলবেয়ার কামুর একটা উক্তি খুব বিখ্যাত—নৈতিকতা আর মানুষের প্রতি দায়বোধের প্রতিটা জিনিস শেখার জন্য আমি ফুটবলের কাছে ঋণী।
একটা মাস আমরা নিজেদের ভুলে থাকলাম, নিজেদের লাভ-ক্ষতি, দুঃখ-বেদনা ভুলে মেতে রইলাম এক চর্মনির্মিত গোলক নিয়ে, এ জন্যও তো বিশ্বকাপের কাছে আমরা ঋণী। আমার মনে হয়, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বিভেদ ভুলে এবার আবার আমাদের নিজেদের কাজে মন বসানোর সময় এসে গেল।
বিজয়ী পক্ষ অবশ্য জয় উদ্যাপন করবে আরও কয়েকটা দিন ধরে। করুক। আনন্দের উপলক্ষ তো আমাদের খুব একটা আসে না। যা আসে, তাকে যেন আমরা সুন্দরভাবে বরণ করে নিতে পারি। অন্যকে আঘাত না দিয়ে।
এই লেখাটা লিখেই আমি ফ্লাইট ধরব রিও ডি জেনিরো অভিমুখে। ওখানে কোপাকাবানা সৈকতে কীভাবে উদ্যাপিত হলো বিশ্বকাপের ফাইনালের মুহূর্তগুলো, তা জানাতে পারব আগামীকাল। অভিনন্দন বিজয়ীদের।