বাফুফের কাছে নেই আন্তর্জাতিক ম্যাচের হিসাব!

১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল।দেশের শীর্ষ ফুটবল তারকারা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তাঁরা কয়টি করে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। ছবি: সংগৃহীত ফাইল ছবি
১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল।দেশের শীর্ষ ফুটবল তারকারা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তাঁরা কয়টি করে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। ছবি: সংগৃহীত ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ফুটবলারদের আন্তর্জাতিক ম্যাচের কোনো হিসাব নেই দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাফুফের কাছে। ব্যাপারটি অবাক করে দেওয়ার মতো হলেও এটাই বাস্তবতা। স্বাধীনতার পর থেকে এযাবত্কালে বাংলাদেশ মোট কতটি ফিফা অনুমোদিত আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাঠে নেমেছে, সেই পরিসংখ্যানও বের করে দিতে অপারগ বাফুফে। বাফুফের কাছে নেই, বিভিন্ন সময় জাতীয় দলের স্থান পাওয়া খেলোয়াড়দের তালিকাও। এমনকি কোন ফুটবলার কবে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সে-সংক্রান্ত কোনো তালিকাও সংরক্ষণ করে রাখেনি ফেডারেশন। সাবেক খেলোয়াড়দের ধুলো জমা স্মৃতিই তাই বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসচর্চার একমাত্র সম্বল।
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দলে নিয়মিত প্রায় সাত-আটজন ফুটবলারের সঙ্গে কথা বলে ইতিহাস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাফুফের এই হতাশাজনক নির্লিপ্ততার দেখা মিলেছে। এই ফুটবলাররা প্রায় সবাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন দীর্ঘ দিন। এঁদের অনেকেই আবার বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাদল রায়, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, কায়সার হামিদ, ওয়াসিম ইকবাল, সাইফুল বারী টিটু, জুয়েল রানা, আলফাজ আহমেদ, হাসান আল মামুনদের মতো ফুটবলাররা কে কয়টি করে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন, সেটা তাঁরা নিজেরাও জানেন না। তাঁরা প্রায় সবাই তাঁদের অভিষিক্ত হওয়ার দিন থেকে যত দিন জাতীয় দলে খেলেছেন, সেই সময়কাল ধরে একটা খসড়া হিসাব সংরক্ষণ করেছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে। কিন্তু তাঁরা কেউই এ ব্যাপারে বাফুফের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাননি বলে এই প্রতিবেদককে জানান।

বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার ওয়েবসাইটে প্রতিটি দেশেরই আন্তর্জাতিক ম্যাচের একটি তালিকা সময়কাল ধরে ফলাফলসহ সংরক্ষিত আছে। ফিফার ওয়েবসাইটসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফুটবল ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৭৩ সাল থেকে এ অবধি বাংলাদেশের খেলা আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা ২০৯টি (বাংলাদেশ সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাঠে নেমেছে গত মার্চ মাসে এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপে মারিয়ানা আইল্যান্ডের বিপক্ষে)। এই ২০৯টি ম্যাচের মধ্যে বাফুফে আয়োজিত কোনো আমন্ত্রণমূলক প্রতিযোগিতার (আগাখান গোল্ডকাপ, প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ, বঙ্গবন্ধু কাপ ইত্যাদি) হিসাব দেওয়া নেই। এই হিসাবটি কেবল বাংলাদেশ জাতীয় দলের সঙ্গে অন্য একটি জাতীয় দলের ম্যাচের হিসাব। সেই হিসাবে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের খেলা আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যাও অনেক কম।

বাফুফের অন্যতম সহ-সভাপতি ও জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক তারকা বাদল রায় বিষয়টি স্বীকার করেছেন অকপটেই। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানিয়েছেন, অতীতে এ বিষয়টি নিয়ে বাফুফে অসম্ভব উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। বাদল রায় বলেন, ‘জাতীয় দলের একজন সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে আমি পরিষ্কার করে বলতে পারব না যে আমি কয়টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছি। আমাদের সময় বাফুফে জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক ম্যাচের কোনো হিসাব রাখেনি। তবে, বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এখন এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’

কায়সার হামিদ ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত জাতীয় দলে টানা খেলেছেন। বাংলাদেশের ফুটবলারদের মধ্যে কায়সার হামিদ দারুণ এক রেকর্ডের অধিকারী। টানা ১১ বছর জাতীয় দলে খেলার সময় তিনি কখনোই মাঠের বাইরে বসে থাকেননি। এমনকি এই সময়ে তিনি জাতীয় দলের জার্সি গায়ে প্রায় প্রতিটি ম্যাচই পূর্ণ সময় খেলেছেন। তবে এই তথ্যটি বাফুফের কোনো আর্কাইভ থেকে পাওয়া যায়নি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে কায়সার নিজেই তা জানিয়েছেন। কায়সার হামিদ বলেন, ‘তথ্যটি আমি আমার স্মৃতি থেকেই বলছি। আমি টানা ১১ বছর জাতীয় দলে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি। এই পুরো সময়টা আমি কখনোই মাঠের বাইরে বসে কাটাইনি। তবে ১৯৯৩ সালের সাফ গেমসে নেপালের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটিতে কোচ আমাকে দ্বিতীয়ার্ধে তুলে নিয়েছিলেন—এটা আমার মনে আছে।’

আন্তর্জাতিক ম্যাচের হিসাব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাফুফের উদাসীনতার বিষয়টি জানেন কায়সারও। তিনি মনে করেন বাফুফের উচিত বিষয়টিতে মনোযোগ দেওয়া। এখন উদ্যোগ নিলেও একটি মোটামুটি আর্কাইভ গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই রক্ষণ তারকা।

ওয়াসিম ইকবাল নিজের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্বের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘জাতীয় দলে আমার অভিষেক ১৯৮০ সালে। তবে আমি ফিফা স্বীকৃত প্রথম ম্যাচ খেলি ১৯৮২ সালের দিল্লি এশিয়ান গেমসে। সেই থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমি জাতীয় দলে খেলেছি। কোনো সফরে ছিলাম, কোনোটিতে ছিলাম না। নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না, আমি আসলে কয়টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছি।’ বাফুফের বিষয়ে ওয়াসিমের বক্তব্য হচ্ছে, ‘দেশের আন্তর্জাতিক ম্যাচের হিসাব সংরক্ষণ করা যে গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার, সেটা বোধ হয় বাফুফে কখনোই অনুধাবন করেনি।’

ইমতিয়াজ সুলতান জনির হিসাবে তিনি ৬১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে খেলেছেন। জনি বলেন, ‘আমি আমার ক্যারিয়ারে দুটি এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব, দুটি বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব, তিনটি এশিয়ান গেমস ও চারটি সাফ গেমসে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলেছি। ১৯৯০ সালের বেইজিং এশিয়ান গেমসে জাপানের বিপক্ষে আমি শেষ ম্যাচ খেলি। আমার হিসাব বলে, আমি ৬১টি ম্যাচ খেলেছি। বাফুফে যে হিসাব রাখে না, সেটা আমি জানি। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তাও হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আমি বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে খোঁজখবর করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।’

সাইফুল বারী টিটু বেশ কয়েকবারই নাকি ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যাপারে বাফুফেতে খোঁজ নিয়েছেন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি জাতীয় দলে খেলেছেন। এই সময়ে তাঁর খেলা আন্তর্জাতিক ম্যাচের হিসাব নিয়ে মনের মধ্যে জাগা কৌতূহল মেটাতে তিনি খোঁজ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে হতাশই হতে হয়েছে বারবার। সাইফুল বারী বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো ফেডারেশন নিজেদের খেলা আন্তর্জাতিক ম্যাচের হিসাব নিয়ে এ ধরনের উদাসীনতার পরিচয় দিতে পারে কি না, আমার জানা নেই।’

সাফ গেমসে দেশকে অধিনায়ক হিসেবে প্রথম সোনার পদক এনে দিয়েছিলেন জুয়েল রানা। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত জাতীয় দলের বেশির ভাগ ম্যাচেই তিনি মাঠে ছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি। বাফুফে কেন দেশের আন্তর্জাতিক ম্যাচের হিসাব রাখেনি, এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই জুয়েলের। তিনি বলেন, ‘এই মৌলিক বিষয়গুলো বাফুফের মাথায় কেন কখনো আসেনি, সেটাই আমি বুঝতে পারি না।’

এই প্রতিবেদনটি তৈরি করার সময় বেরিয়ে এসেছে একটি চমকপ্রদ তথ্যও। এই তথ্য ১৯৯৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত টানা জাতীয় দলে খেলা দুই ফুটবলার আলফাজ আহমেদ ও হাসান আল মামুনকেও বিস্ময়াভূত করেছে। ১৯৯৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সময়কালে এই দুই ফুটবল তারকা যে শতাধিক আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাঠে নেমেছেন, সেই হিসাব তাঁদের কাছেও ছিল না। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তথ্যটি বেরিয়ে আসার পরও পুরোপুরি উচ্ছ্বসিত হতে পারলেন না এই দুই ফুটবলার। তাঁরা বলেন, যদি ১০০টি ম্যাচ খেলেও থাকেন, সেটা তো একটা অর্জন। কিন্তু বাফুফের কাছ থেকে কোনো দিনই এ বিষয়ে কিছু তাঁরা জানতে পারেননি।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো ফুটবলার শততম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললে তাঁকে নিজ দেশের ফুটবল ফেডারেশন বিশেষভাবে সম্মানিত করে। একজন ফুটবলারের ১০০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার ব্যাপারটিকে ধরা হয় অনন্য এক অর্জন হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এসবের ধার ধারে না বলেই চলে।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে হাসান আল মামুন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ম্যাচের সময় প্রতিটি খেলার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা ব্যয়সাধ্য বা কঠিন কোনো বিষয় নয়। আয়োজকদের বললেই তাঁরা তা জোগাড় করে দেন। বাংলাদেশ দলের ম্যানেজমেন্টও তা সংগ্রহ করেছে সব সময়ই। সেগুলো পরে বাফুফেতে জমাও দেওয়া হয়। বাফুফে ওগুলো সংরক্ষণ করেছে কি না, সেটা বলতে পারব না।’

আলফাজ নিজের জাতীয় দলে খেলার সময়কাল ধরে হিসাব করে বলেন, ‘এই পুরো সময় আমি মাত্র দু-তিনটি ম্যাচে খেলিনি। বাকি সব কয়টি ম্যাচেই মাঠে নামার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ১০০টি ম্যাচ খেলতে পারি। কিন্তু বাফুফে আমাকে না জানালে আমি নিশ্চিত হব কীভাবে। মাঠে খেলার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করা নিশ্চয়ই খেলোয়াড়দের কাজ নয়।’

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি ও দেশের ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি কাজী সালাউদ্দিন নিজে ১০ বছর জাতীয় দলে খেলেছেন। ১৯৭৩ সালে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের প্রথম ম্যাচটিতে গোলও এসেছিল সালাউদ্দিনের পা থেকে। তিনি নিজেও সন্দিহান অতীতে ফেডারেশন আন্তর্জাতিক ম্যাচের কোনো হিসাব রেখেছে কি না। সালাউদ্দিন এ ব্যাপারে প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘আমি নিজেও জানি না, আমি দেশের হয়ে কয়টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছি। সুতরাং এটা ধরে নিতে পারেন যে বাফুফে অতীতে এই হিসাব রাখেনি। তবে আমি বলতে পারি, ২০০৮ সালে আমি সভাপতি হওয়ার পর থেকে এই হিসাবটা রাখা শুরু হয়েছে। আমি অতীতের কথা বলতে পারব না, তবে বাফুফের কাছে ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ম্যাচের পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড সংরক্ষিত আছে।’