বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাংলাদেশও

বিশ্বকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ তো নিয়মিতই খেলে—প্রথম বাক্যটি পড়ে যারা যারপরনাই বিরক্ত, তাঁদের অনুরোধ করছি, দয়া করে রাগ করবেন না। এই লেখাকে ‘বালখিল্য’ হিসেবেও অভিহিত করবেন না। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নিয়মিত খেলে—কথাটা পুরোপুরি না হলেও আংশিক সত্যি। হালফিলে একে ভুল হিসেবেও চিহ্নিত করাও সম্ভব নয়। বিশ্বকাপ বলতে যদি আপনি কেবল চার বছর পরপর আয়োজিত ৩২ দেশের মহাযজ্ঞকে বোঝেন, তা হলে ঠিক আছে। কিন্তু ওই ৩২টি দল বাছাই করতে যে বিশ্বব্যাপী আরেক মহাযজ্ঞ আয়োজিত হয়, তাকে যদি আপনি বিশ্বকাপ হিসেবে অভিহিত করতে না চান, তা হলে সত্যিই সমস্যা আপনার মধ্যেই আছে।
পাঠকেরা নিশ্চয়ই প্রচণ্ড বিরক্ত! পুরো ব্যাপারটিকেই ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ হিসেবে মনে করছেন অনেকে। আসলে বিশ্বকাপের সঙ্গে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতা টেনে আনতেই এত কিছুর অবতারণা করতে হলো। মূল কথা হলো, ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব থেকে এ অবধি বাংলাদেশ ছিল প্রতিটি বিশ্বকাপেরই অংশ। বাছাইপর্বে বাংলাদেশের ফলাফলটা জেনে রাখুন, এ অবধি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ৪০ ম্যাচে মাঠে নেমে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে নয়টিতে। ২৭টিতে হেরে আর চারটি ম্যাচ ড্র করে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স চিরাচরিতই। ৪০ ম্যাচে বাংলাদেশের গোলসংখ্যা ৩১টি। আর ৯১টি গোল খেয়ে প্রমাণ করেছে ফুটবলে আমাদের অবস্থানটি।
আমাদের এই লেখা বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের খতিয়ান নিয়ে নয়। প্রিয় পাঠক, আসুন, আমরা বরং বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সামগ্রিক ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করি। স্মৃতির পাতা থেকে খুঁজে নিই বাংলাদেশের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের বিভিন্ন দিক...
প্রথম অধিনায়ক
১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাইপর্বটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম ‘বিশ্বকাপ’। ঐতিহাসিক সেই মিশনে অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল আশীষ ভদ্রের হাতে। আশীষ কেবল ওই সময়েরই নয়, বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসেরও অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার হিসেবে পরিচিত। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে একাধিকবার অধিনায়কত্ব করেছেন কায়সার হামিদ । নব্বই ও চুরানব্বইয়ের বিশ্বকাপ বাছাই তাঁর হাতে ছিল অধিনায়কের আর্মব্যান্ড।

প্রথম জয়
১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে। প্রথমবার বাছাইপর্বে খেলতে নেমেই ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে এক দারুণ জয় তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রথম পর্বে জাকার্তার অ্যাওয়ে ম্যাচে ইন্দোনেশিয়ার কাছে ২-০ গোলে হারলেও ঢাকার ফিরতি ম্যাচে এক গোলে পিছিয়ে পড়েও ২-১ গোলের এক দারুণ জয় পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে গোল করেছিলেন আশরাফউদ্দিন চুন্নু ও কায়সার হামিদ।
কঠিনতম মিশন
একটা সময় ছিল যখন বাছাইপর্বে এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলোর সঙ্গেই খেলতে হতো বাংলাদেশকে। শীর্ষ বলতে এই ইরান, জাপান, আরব আমিরাত, সৌদি আরবের মতো দেশগুলো। প্রথমবারের মিশনে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারত গ্রুপে থাকলেও পরের দুবার, অর্থাত্ ১৯৯০ ও ১৯৯৪-এর বাছাইপর্বে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল ইরান, জাপান, চীন ও আরব আমিরাতে—এ দেশগুলোর প্রতিটিরই কোনো না-কোনো সময় বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত ’৯৪-এর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বকেই বাংলাদেশের কঠিনতম মিশন হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। সেবার জাপান ও আমিরাতের সঙ্গে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল ফুটবলে ক্রমান্বয়ে ‘শক্তিধর’ হয়ে ওঠা থাইল্যান্ড। জাপান ও আমিরাতের বিপক্ষে টোকিও ও দুবাই রাউন্ডের দুটো ম্যাচে যথাক্রমে ৮-০ ও ৭-০ গোলের হারের লজ্জাতেও পড়তে হয় বাংলাদেশকে। থাইল্যান্ডের বিপক্ষে দুই রাউন্ডেই বাংলাদেশ হারে ৪-১ গোলে। দুই লেগে আটটি ম্যাচে বাংলাদেশকে গোল হজম করতে হয়েছিল ২৮টি।
প্রাণান্তকর লড়াই
১৯৮৯ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ইরানের বিপক্ষে দুটো ম্যাচেই সমান তালে লড়াই করে হেরেছিল বাংলাদেশ। ঢাকার প্রথম পর্বে ২-১ গোলের হারের ম্যাচে খেলার শুরুতেই পেনাল্টি পেয়ে যায় বাংলাদেশ। তবে সেই পেনাল্টি ক্রসবারে মেরে নষ্ট করেন রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির। খেলাটিতে বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন আসলাম। প্রাপ্ত কর্নার থেকে আসলামের দুর্দান্ত হেডে পরাভূত হয়েছিলেন ইরানের তারকা গোলরক্ষক আহমেদ রেজা আবেদ জাদেহ।
তেহরানের অ্যাওয়ে ম্যাচটি ছিল খুব সম্ভবত আশির দশকে বাংলাদেশের সেরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ। বিখ্যাত আজাদি স্টেডিয়ামে ৭০ হাজার দর্শকের গগনবিদারী চিত্কারের সামনে বাঘের মতো লড়াই করেছিলেন কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, আসলাম, সাব্বিররা। ইরানের একটি পেনাল্টিও ঠেকিয়ে দেন গোলরক্ষক মহসিন। একেবারে শেষ মুহূর্তে গেহেরগান নামের এক ফুটবলারের লক্ষ্যভেদী হেড পণ্ড শেষ করে দেয় ইরানকে রুখে দেওয়ার স্বপ্ন।
১৯৯৩ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে জাপানের ইয়োকোহামায় আরব আমিরাতের কাছে ১-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। আমিরাত সেই ম্যাচে জয় পেয়েছিল পেনাল্টি থেকে। ওই ম্যাচেই একটি পেনাল্টি ঠেকিয়েছিলেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক মহসিন। ১৯৮৯ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে চীনের বিপক্ষে গুয়াংজু ও ঢাকার দুই ম্যাচেই দ্বিতীয়ার্ধে গোল খেয়ে হেরেছিল বাংলাদেশ। দুই ম্যাচেই স্কোরলাইন ছিল ২-০।

জয়ের আনন্দ
১৯৮৫-এর বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঢাকায় ইন্দোনেশিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেবারই ঢাকায় থাইল্যান্ডের বিপক্ষে জয় এসেছিল ১-০ গোলে। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় থাইল্যান্ডকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল সাব্বির, রুপু, ওয়াসিমরা। ১৯৯৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জাপান-আমিরাত দুই পর্বেই জয় এসেছিল যথাক্রমে ১-০ ও ৩-০ গোলের। ১৯৯৭ সালে জেদ্দায় চায়নিজ তাইপেকে ২-১ গোলে হারায় জুয়েল রানার বাহিনী। ২০০১ সালে সৌদি আরবের দাম্মামে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে একটি ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছিল ৩-০ গোলে। তবে সব ম্যাচ ছাপিয়ে ২০১১ সালে এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঢাকায় ২-০ গোলে লেবাননকে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচটিই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দেয় ফুটবলপ্রেমীদের।
সবচেয়ে বেশি গোলবার আগলানোর রেকর্ড
মোহাম্মদ মহসিন সবচেয়ে বেশিবার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের গোলবার আগলেছেন। তিনি টানা বাংলাদেশের অংশ নেওয়া টানা তিনটি বাছাইপর্বে জাতীয় দলের এক নম্বর গোলরক্ষক ছিলেন। এ ছাড়া সাঈদ হাসান কানন, আমিনুল হক, মোহাম্মদ পনির ও বিপ্লব ভট্টাচার্য বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের গোলরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাছাইপর্বে মহসিনের পর সবচেয়ে বেশিবার বাংলাদেশের গোলপোস্টে দাঁড়িয়েছেন আমিনুল হকই।
চোখ ধাঁধানো গোল
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের পক্ষে গোল হয়েছে ৩১টি। এই গোলগুলোর মধ্য থেকে সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো গোলটি বেছে নেওয়া খুব কঠিন নয়। ১৯৮৫ সালের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে দারুণ এক ফ্রি কিকে গোল করেছিলেন আশরাফউদ্দিন চুন্নু। আজ থেকে ২৯ বছর আগের সেই গোল আজও চোখে ভাসে ওই প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের। ১৯৮৯ সালে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ঢাকায় প্রায় মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে চারজন থাই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ‘ম্যারাডোনা স্টাইলে’ অসাধারণ এক গোল করেছিলেন রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির। চোখ ধাঁধানো গোলের তালিকার সেরা হতে আশরাফউদ্দিন চুন্নুর সঙ্গে জোর লড়াইই হওয়ার কথা এ দেশের ফুটবলের সেরা এই প্লেমেকারের।
প্রিয় প্রতিপক্ষ
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সবচেয়ে বেশিবার থাইল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। বাছাইপর্বে অংশ নেওয়ার প্রথম তিনবারই বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল থাইল্যান্ড। প্রিয় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলা ছয়টি ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে দুটিতে। দুটোই ঢাকায় (১৯৮৫ ও ১৯৮৯)। বাকি চারটি ম্যাচের দুটি হার ব্যাংককে। বাকি দুটো টোকিও ও দুবাইয়ে। সৌদি আরবের সঙ্গেও পরপর দুটি বাছাইপর্বে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালে কুয়ালালামপুর ও জেদ্দা ও ২০০১ সালে দাম্মামে হয়েছিল এই চারটি লড়াই। বলা বাহুল্য, চারটি ম্যাচেই হারই ছিল বাংলাদেশের সঙ্গী। ২০০৬ ও ২০১০ বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাইয়ের চারটি ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল তাজিকিস্তান।