মানজারুলদের মৃত্যু আকুতি জাগায় নিরাপদ সড়কের

সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল মানজারুল ইসলাম রানাকেফাইল ছবি

১৬ মার্চ এলেই মনে পড়ে যায় মানজারুল ইসলাম রানার কথা। তাঁর মৃত্যুদিন। অমিত সম্ভাবনাময় এই ক্রিকেটার ফুল হয়ে ফুটতে পারেননি। দেশের হয়ে ৬ টেস্ট আর ২৫ ওয়ানডে খেলেই থেমে গেছেন। থেমে গেছেন বললে ভুল হবে, তাঁকে থামিয়ে দিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। দেশের সড়ক অব্যবস্থাপনার বলি হয়েছিলেন মানজারুল রানার মতো একজন সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের দারুণ এক সম্পদ। সাকিবপূর্ব যুগে এই মানজারুলই দেখিয়েছিলেন, বাঁহাতি স্পিনের সঙ্গে কার্যকর ব্যাটিং মিলিয়ে চাইলে বাংলাদেশ থেকেও বিশ্বমানের অলরাউন্ডার উঠে আসতে পারে।

দেখতে দেখতে ১৫ বছর পার হয়ে গেল। ২০০৭ সালের ১৬ মার্চ খুলনার ডুমুরিয়ায় মোটরবাইক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন মানজারুল। কেবল তিনিই নন, সেদিন বাইকে তাঁর সঙ্গী সাজ্জাদুল হাসানও প্রাণ হারিয়েছিলেন একই দুর্ঘটনায়। সাজ্জাদুল হাসানও ছিলেন খুলনা বিভাগীয় দলের ক্রিকেটার। প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁরও।

জাতীয় ক্রিকেট দলের বাইরেই ছিলেন মানজারুল সে সময়। বাংলাদেশ দল খেলতে গিয়েছিল বিশ্বকাপে। পরদিন ১৭ মার্চ পোর্ট অব স্পেনে ছিল ভারতের বিপক্ষে লড়াই। সে ম্যাচে নামার আগ দিয়েই শোকে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল গোটা দল। মানজারুল যে কেবল মাশরাফি-সাকিব-মুশফিকুরদের সতীর্থই ছিলেন না, ছিলেন খুব ভালো বন্ধুও। সাজ্জাদুলও ছিলেন খুলনা বিভাগীয় দলের অনেকেরই ভালো বন্ধু। প্রিয় বন্ধু। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে মাঠে নামার আগে বন্ধুদের অপঘাতে মৃত্যুর খবর সহ্য করাও কঠিন। সেই শোককে শক্তি বানিয়ে পরদিন শচীন টেন্ডুলকার, বীরেন্দর শেবাগ, সৌরভ গাঙ্গুলী, যুবরাজ সিং, রাহুল দ্রাবিড়দের ভারতকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ।

খুলনায় একটি ম্যাচ খেলছিলেন মানজারুল। দিনের খেলা শেষে বাইকে সাজ্জাদুলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন প্রিয় রেস্তোরাঁয় খাওয়ার উদ্দেশ্যে। এমনিতে যথেষ্ট সাবধানী চালক ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যে সেদিন মৃত্যুই লেখা ছিল তাঁর। দেশের সড়কব্যবস্থা, এর অব্যবস্থাপনার সুযোগ নেওয়া ঘাতক ট্রাক সেদিন মানজারুলকে রেহাই দেয়নি। এই সড়ক ঘাতকদের হাত থেকে যেমন কোনো দিনই রেহাই মেলে না হাজার হাজার মানুষের।

প্রয়াত অ্যাথলেট শাহ আলম।
ছবি: সংগৃহীত

সড়ক দুর্ঘটনা দেশের বড় একটা সমস্যা। শহরগুলোয় কিংবা মহাসড়কে প্রতিদিনই প্রাণ হারায় সাধারণ মানুষ। এই সমস্যার সমাধান আজ পর্যন্ত বের করতে পারেনি এই দেশ। পৃথিবীর অন্যতম অনিরাপদ সড়কব্যবস্থার বলি হতে হয় সাধারণ মানুষকে। এই দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে অনেক গুণী মানুষকে। মানজারুল ইসলাম রানার মতো সড়কে প্রাণ গেছে দেশের সর্বকালের সেরা দুই দৌড়বিদেরও। একসময় দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব শাহ আলম, বিখ্যাত স্প্রিন্টার মাহবুব আলমকে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন বলতে গেলে অকালেই হারিয়েছিল।

এই প্রজন্ম প্রায় ভুলেই গেছে এই দুই দৌড়বিদকে। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। শাহ আলম ও মাহবুব আলম—দুজনই ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসসেরা অ্যাথলেট। প্রথমজন সাফ গেমসে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে পরপর দুবার রেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছিলেন, হয়েছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব। পরেরজন সাফ গেমসেই ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা এনে দিয়েছিলেন দেশকে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল এই দুই কীর্তিমান অ্যাথলেটকে।

শাহ আলমের মতো দেশের অন্যতম সেরা অ্যাথলেট মাহবুবও প্রাণ হারিয়েছিলেন সড়কে
ফাইল ছবি

আশির দশকে শাহ আলম ছিলেন দেশের সেরা দৌড়বিদ। সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন তিনি। ১৯৮৪ সালে কাঠমান্ডু সাফ গেমসে তিনি প্রথম নজর কেড়েছিলেন। সেবার ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে সোনা জিতেছিল বাংলাদেশ। শাহ আলম ছিলেন সেই বিজয়ী দলের অন্যতম সদস্য। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমস তাঁকে বানিয়ে দেয় দেশের ক্রীড়া ইতিহাসের অন্যতম বড় তারকা। সেবার ১০০ মিটার স্প্রিন্টে নতুন সাফ গেমস রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি ১০.৮০ সেকেন্ড সময় নিয়ে। ১৯৮৭ সালে কলকাতায় পরের সাফ গেমসে শাহ আলম ভেঙেছিলেন নিজের রেকর্ডই। ১০.৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি টানা দ্বিতীয়বারের মতো হয়েছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব।

১৯৯০ সালের ২৯ মে সড়কে প্রাণ যায় শাহ আলমের। বাংলাদেশের খেলার ইতিহাসে শোকবিধুর এক দিন সেটি। নিজের জন্মস্থান মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সাহেবনগর থেকে শাহ আলম মোটরবাইকে করে ঢাকা যাচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য বেইজিং এশিয়ান গেমসের ক্যাম্পে যোগ দেওয়া। পাবনার কাশিনাথপুরে ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারান শাহ আলম। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন কি না, সেটা জানা যায়নি। কারণ, তাঁর মৃতদেহ শনাক্তই হয়েছিল বেশ কয়েক ঘণ্টা পর।

১৫ বছর হয়ে গেল মানজারুলের মৃত্যুর
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আরেক ধূমকেতু মাহবুব আলম। নৌবাহিনীর অ্যাথলেট। ১৯৯৫ সালে বলা নেই কওয়া নেই ঝড়ের বেগে সাফ গেমসে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে মাদ্রাজ (চেন্নাই) সোনা জিতে ফেললেন মাহবুব। শাহ আলমের যোগ্য উত্তরসূরিকেই পেয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু সাফে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে তাঁর সোনা হাতছাড়া হয়ে যায় ফটো ফিনিশে। ২০১০ সালে মাহবুবকেও কেড়ে নেয় সড়ক দুর্ঘটনা। কুমিল্লা থেকে মাইক্রোবাসে করে ঢাকা ফেরার পথে কাঁচপুরের কাছে ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় সেই মাইক্রোবাসের। সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়েছিল মাহবুবের।

মানজারুল ইসলাম, শাহ আলম, মাহবুব আলম—দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের অন্যতম তিন সেরা ও সম্ভাবনাময় তারকাকে আমরা হারিয়েছি সড়ক দুর্ঘটনায়। এমনি করে কতশত মানুষ অকালে হারিয়ে যাচ্ছে সড়কের ফাঁদে। মানজারুল, শাহ আলম, মাহবুব আলমরা যেন এখন হয়ে উঠছেন নিরাপদ সড়কেরই আকুতি।