রাকিব-রানীর অপেক্ষার 'প্রথম'

প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার টিকিট পাওয়ার অনুভূতি কতটা মধুর হতে পারে, তা বোধ হয় আবদুল্লাহ আল রাকিব ও রানী হামিদই এখন ভালো বলতে পারেন।
কাঠমান্ডু থেকে সতীর্থদের সঙ্গে বিমানবন্দরে নামার পর কাল বিকেলে রাকিবের কথায় সেটাই বোঝা গেল, ‘আরে, আমি তো গতবার বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার এই জোনাল পর্বে খুব ভালো খেলেছিলাম। কিন্তু রানারআপ হয়ে শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ মিস করি। এবার তুলনামূলক একটু কম ভালো খেলেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপের টিকিট ধরা দিয়েছে। বিশ্বকাপ দাবায় খেলব প্রথম। এটা ভাবলেই খুব খুশি খুশি লাগছে।’
আর রানী হামিদ? ফেব্রুয়ারিতে ৭৪ বছরে পা দিয়ে অবশেষে নিজের প্রথম মহিলা বিশ্বকাপে খেলার টিকিট এখন তাঁর হাতে। কাঠমান্ডুর এই জোনাল চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা হওয়ার উচ্ছ্বাস বেরিয়ে আসে কথায়। ক্যারিয়ারে এটিই কি তাঁর সেরা অর্জন? ‘ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়কে সবকিছুর ওপরে রাখি। ব্রিটিশরা আমাদের ২০০ বছর শাসন করেছে, গোলামের মতো দেখেছে। ওটা ছিল অন্য রকম। তবে দাবার ক্যারিয়ার দেখলে এই চ্যাম্পিয়নশিপকে এক নম্বর বলব’—২০১৮ নারী বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাওয়ায় রোমাঞ্চিত রানী হামিদ।
ফিদের নিয়ম অনুযায়ী, আঞ্চলিক পর্বে পুরুষ ও মহিলা বিভাগের দুই চ্যাম্পিয়নই বিশ্বকাপে সুযোগ পান। আর কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চল মানেই বাংলাদেশিদের জয়জয়কার। ভারত আলাদা অঞ্চল হয়ে যাওয়ায় নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপের মতো দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের দাবাড়ুরাই সেরা। এবার তো পাকিস্তানও আসেনি।
এলেই বা কী, ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া এই সাফ অঞ্চলে আর কোনো দেশে গ্র্যান্ডমাস্টারই নেই। ফলে ১৯-২৭ মার্চ কাঠমান্ডুতে এশিয়ান জোনাল দাবায় বাংলাদেশের দাবাডুরা নিজেরাই থাকলেন নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী। টুর্নামেন্টে মহিলা বিভাগে গতবারের চ্যাম্পিয়ন শামীমা আক্তার লিজা রানারআপ। নাজরানা খান ইভা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নর্ম করেছেন। সব দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য প্রাপ্তির এক টুর্নামেন্ট।
এখানে চ্যাম্পিয়ন হয়েই গত তিনবার জিয়াউর রহমান বিশ্বকাপে খেলেছেন। নিয়াজ মোরশেদও আঞ্চলিক রানারআপ হয়ে ১৯৯৭ সালে খেলেছেন বিশ্বকাপে। এনামুল হোসেন রাজীব এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে কোয়ালিফাই করে গেছেন বিশ্বকাপে।
আগামী সেপ্টেম্বরে জর্জিয়ায় পরের বিশ্বকাপে খেলবেন—রাকিবের কাছে শুধু এটাই আনন্দের নয়, কাঠমান্ডুতে জেনাল চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ে একটা অতৃপ্তিও দূর হয়েছে তাঁর। ২০০৭ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর যে দেশের বাইরে এটাই প্রথম টুর্নামেন্ট জয়। কাঠমান্ডুতে নয় ম্যাচে পেয়েছেন ৮ পয়েন্ট। দুটি ড্র জিয়া ও ফিদে মাস্টার ইমনের সঙ্গে। রাকিব বলছিলেন, ‘এই টুর্নামেন্টে কখনো কখনো মনে হয়েছে ঘরেই খেলছি।’
রানী হামিদ এখন আর তেমন কোনো লক্ষ্য নিয়ে খেলেন না। নিজেই বলেন, ‘এখন আসলে সময় কাটাতে দাবা খেলি।’ হাসতে হাসতে যোগ করেন, ‘এবার তো ভাবছিলাম লাস্ট হয়ে যাই কিনা। আমার তো অনুশীলন সেভাবে নেই। অন্যদের সামনে দাঁড়াতে পারব না মনে হচ্ছিল।’
অথচ রানী ৯ ম্যাচে ৮ পয়েন্ট পেয়ে চ্যাম্পিয়ন! তাঁর কথায় মনে হচ্ছিল, আহা, কত দিন পর স্বপ্নপূরণ! বারবার বলেন, ‘অপোনেন্ট হারায় না আমাকে, নিজেই নিজেকে হারাই।’ ১৯৮২ সালে আধ পয়েন্ট বেশি নিয়ে ভারতের সেরা খেলোয়াড়ের সঙ্গে বোর্ডে বসেছিলেন। ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন। ‘এগিয়ে থেকেও জিততে পারিনি সেদিন। এত দিন হয় সিলভার, নয় তো ব্রোঞ্জ পেয়েছি। দুবাইয়ের এক আরবিট্রেটর একবার মজা করে আমাকে বলেন, ‘তুমি কি বাড়ি থেকে বের হও দ্বিতীয় বা তৃতীয় হতে।’
৭৩ পেরিয়ে সেই বৃত্ত ভেঙে রানী নিজেকে চেনালেন নতুনভাবে।