রেফারি যখন খলনায়ক!

১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে মেক্সিকান রেফারি মেনডেজ হলুদ কার্ড দেখাচ্ছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত রেফারিং করে এই ম্যাচে খলনায়ক হয়েছিলেন তিনি
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে মেক্সিকান রেফারি মেনডেজ হলুদ কার্ড দেখাচ্ছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত রেফারিং করে এই ম্যাচে খলনায়ক হয়েছিলেন তিনি

ফুটবল মাঠে নিরপেক্ষ ভূমিকাই আশা করা হয় রেফারিদের কাছ থেকে। বিশ্বকাপের মতো আসরে তো সেই প্রত্যাশা আরও বেশি থাকে। কিন্তু বিশ্বকাপ ইতিহাসে এমন অনেক ম্যাচই দেখা গেছে, যেখানে চরম বিতর্কিত ভূমিকা ছিল ম্যাচ পরিচালনাকারীদের। অনেক ক্ষেত্রেই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গেছে রেফারিদের সেই সব বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জন্য। সেই রেফারিরাও ফুটবল বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন খলনায়ক হিসেবে। রেফারিদের তেমন কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কথাই থাকছে এই প্রতিবেদনে।

আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্স, ১৯৩০
খেলা শেষ হওয়ার আগেই শেষ বাঁশি বাজিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে ফুটবল বিশ্বকাপে। ১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্সের ম্যাচে ছয় মিনিট বাকি থাকতেই খেলা শেষ করে দিয়েছিলেন রেফারি। ১-০ গোলের জয় নিয়ে উল্লাস করতে করতেই সাজঘরে ফিরেছিলেন আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা। কিন্তু ফরাসিদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে আবারও খেলোয়াড়দের মাঠে ডাকতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই ম্যাচের রেফারি। আবারও মাঠে নামতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তারাই ম্যাচটা জিতেছিল ওই ১-০ গোলের ব্যবধানেই।

ব্রাজিল বনাম সুইডেন, ১৯৭৮

কর্নার কিক থেকে ভেসে আসা বলে মাথা ছুঁইয়ে সেটা প্রতিপক্ষ সুইডেনের জালে জড়িয়েই দিয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি জিকো। কিন্তু ওয়ালসের রেফারি ক্লাইভ টমাস সেটাকে গোল হিসেবে গণ্য করেননি। কারণ কর্নার কিকটি নেওয়ার পরপরই তিনি বাজিয়ে দিয়েছিলেন শেষ বাঁশি। ম্যাচটি শেষ হয়েছিল ১-১ গোলের ড্র দিয়ে। ব্রাজিলের সমর্থকেরা তীব্র সমালোচনা করেছিলেন রেফারির।

ইতালি বনাম চেকোস্লোভাকিয়া, ১৯৩৪

ইতালিতে আয়োজিত ফুটবল বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসরকে নিজের শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বেনিতো মুসোলিনি। ইতালি ফাইনালে পৌঁছানোর পর যেকোনোভাবেই শিরোপা জয় নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন ইতালির এই স্বৈরশাসক। ফাইনালের রেফারি হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সুইডেনের ইভান ইকলিন্ডকে। সুইডিশ এই রেফারিও নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বেশ ‘ভালোভাবেই’। ইতালির খেলোয়াড়দের ভয়াবহ সব ফাউল দেখেও না দেখার ভান করেছিলেন। নিশ্চিত একটা পেনাল্টি থেকেও বঞ্চিত করেছিলেন চেকোস্লোভাকিয়াকে। শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলের জয় দিয়ে শিরোপা জিতেছিল ইতালি।

পশ্চিম জার্মানি বনাম ফ্রান্স, ১৯৮২

১৯৮২ সালের উত্তেজনাপূর্ণ এই সেমিফাইনালটি স্মরণীয় হয়ে আছে রেফারির একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জন্য। ১-১ ব্যবধানে সমতা থাকার সময় চমত্কার একটি গোলের সুযোগ তৈরি করেছিলেন ফ্রান্সের প্যাট্রিক ব্যাটিসটন। কিন্তু এ সময় জার্মানির গোলরক্ষক হ্যারাল্ড শুমাখার প্রচণ্ড জোরে আঘাত করেন ব্যাটিসটনকে। চোয়াল ভেঙে স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়েন ফরাসি এই ডিফেন্ডার। ভয়াবহ এই ফাউলের পরও শুমাখারকে কোনো কার্ড দেখাননি রেফারি। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে জয় পেয়ে ফাইনালে গিয়েছিল জার্মানি।

আর্জেন্টিনা বনাম পশ্চিম জার্মানি, বিশ্বকাপ ফাইনাল, ১৯৯০

নব্বইয়ের বিশ্বকাপ ফাইনাল ছিল রেফারির বাজে সিদ্ধান্তে বিতর্কিত। মেক্সিকান রেফারি কোডেশাল মেন্ডেজের মাধ্যমে সেদিন ‘উপকৃত’ হয়েছিল পশ্চিম জার্মানি। ভাঙা দল নিয়ে আর্জেন্টিনা সেবার ডিয়েগো ম্যারাডোনার নেতৃত্বে পৌঁছে গিয়েছিল ফাইনালে। প্রতিপক্ষ জার্মানি আবার ছিল ওই বিশ্বকাপের সেরা দল। ফাইনালেও রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে জার্মানিকে প্রায় ঠেকিয়েই দিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু খেলার শেষের দিকে মেক্সিকান রেফারি পেনাল্টি দেন জার্মানিকে। ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান একটি বল নিয়ে আর্জেন্টিনার বক্সে ঢুকে পড়লে তিনি যে বাধার শিকার হয়েছিলেন, সেটা ফাউল ছিল কি না, তা নিয়ে এত বছর পরেও বিতর্ক চলে। সেই পেনাল্টি থেকেই আন্দ্রেস ব্রেইমে গোল করে ১৯৭৪ সালের পর প্রথমবারের মতো (এখনো পর্যন্ত শেষবার) বিশ্বকাপ জিতিয়েছিল জার্মানিকে। রেফারি সেদিন কেবল পেনাল্টি দিয়ে ক্ষান্ত দেননি, লাল কার্ড দেখিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন দুই খেলোয়াড়কে। বিশ্বকাপ ফাইনালে কোনো খেলোয়াড়ের লালকার্ড দেখার ঘটনা ওটাই প্রথম।

দক্ষিণ কোরিয়া বনাম ইতালি, ২০০২

স্বাগতিক দলকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার ঘটনা অনেকবারই ঘটেছে বিশ্বকাপ ফুটবলে। আধুনিক কালে এমন নজির দেখা গেছে ২০০২ সালে, দক্ষিণ কোরিয়া বনাম ইতালির শেষ ষোলোর ম্যাচে। খেলা শুরুর চতুর্থ মিনিটেই কোরিয়াকে বিতর্কিত একটা পেনাল্টি দিয়েছিলেন ইকুয়েডরের রেফারি বায়রন মোরেনো। সেই পেনাল্টি থেকে অবশ্য গোল করতে পারেনি কোরিয়া। নির্ধারিত ৯০ মিনিট ১-১ গোলে সমতার পর অতিরিক্ত সময়ে ইতালির প্রধান খেলোয়াড় ফ্রান্সিসকো টট্টিকে লাল কার্ড দেখিয়েছিলেন রেফারি। এটাও ছিল একটা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচটা জিতেছিল ২-১ গোলে। কোয়ার্টার ফাইনালেও রেফারির সহায়তা পেয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। স্পেনের দুটি ন্যায্য গোল নাকচ করে দিয়েছিলেন সেই ম্যাচের রেফারি। টাইব্রেকারে জিতে সেমিফাইনালে গিয়েছিল স্বাগতিক দল কোরিয়া।