সামনে যখন বিশ্বসেরা দাবাড়ু

বাকুর দাবা অলিম্পিয়াডে ম্যাগনাস কার্লসেনের মুখোমুখি এনামুল হোসেন রাজীব l ফাইল ছবি
বাকুর দাবা অলিম্পিয়াডে ম্যাগনাস কার্লসেনের মুখোমুখি এনামুল হোসেন রাজীব l ফাইল ছবি

ম্যাচের দিন সকালে জানলেন আজকের প্রতিপক্ষ কে। নামটা শিহরণ জাগানো। সেই শিহরণ নিয়েই এনামুল হোসেন রাজীব টেবিলে যাঁর সামনে বসলেন, তিন বছর ধরে দাবা-বিশ্বের রাজদণ্ড তাঁরই হাতে। ম্যাগনাস কার্লসেন!

আজারবাইজানের বাকুতে ৩ সেপ্টেম্বর দিনটা তাই রোমাঞ্চের অন্য নাম হয়ে গেল বাংলাদেশের সর্বশেষ গ্র্যান্ডমাস্টারের কাছে। ৪২তম দাবা অলিম্পিয়াডে বিশ্বসেরা দাবাড়ুর বিপক্ষে খেলার সুযোগ পাবেন, এটা তো আর আগে থেকে জানা ছিল না। আগের রাতে ‘জোড়া বাছাইয়ে’ দাবার অন্যতম পরাশক্তি কার্লসেনের নরওয়ের সামনে পড়ল বাংলাদেশ। কার্লসেন চাইলে বিশ্রাম নিতে পারতেন। কিন্তু সবার আগে এসে বোর্ডে হাজির তিনিই! একাকী মিনিট দশেক বোর্ডে বসে মগ্ন রইলেন ম্যাচ প্রস্তুতিতে। যেন ওই সাদা-কালো ৬৪ ঘর ছাড়া জগৎসংসারের আর কিছু নেই! এক নম্বর বোর্ডের অন্য প্রান্তে বাংলাদেশের রাজীব। অসম এক লড়াই শুরু!

হ্যাঁ, অসমই। কার্লসেনের সঙ্গে বিশ্বনাথন আনন্দের মতো মস্তিষ্কও পেরে ওঠে না। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ইতিহাসের তৃতীয় কনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার এখন সর্বকালের সেরা রেটিংধারীও। একসময় সর্বোচ্চ রেটিংয়ের রেকর্ডের গর্বিত মালিক ছিলেন গ্যারি কাসপরভ (২৮৫১)। তাঁকেও ছাড়িয়ে কার্লসেন এখন ২৮৮২। অলিম্পিয়াডে এসেছিলেন ২৮৫৭ নিয়ে। দাবার সেই ‘জীবন্ত কম্পিউটারের’ সামনে ২৪৩১ রেটিংয়ের রাজীব। বোড়ে-হাতি-ঘোড়ার জটিল অঙ্কের খেলায়ও ব্যবধানটা ফুটে বেরিয়েছে। ৩৩ চালেই কিস্তিমাত।

কার্লসেন শুরুই করলেন চমক দিয়ে। সাদা নিয়ে সাধারণত e4 বা d4 চালই দেন দাবাড়ুরা। অনেক সময় ঘোড়াও বের করেন। তবে এদিন রাজার সামনের বোড়ে এক ঘর ঠেলে দিলেন কার্লসেন (e3)। যা দেখে দর্শকদের মধ্যেও বিস্ময়, এটা কী চাল দিলেন কার্লসেন! এই চাল আগে নাকি কখনোই দেননি কার্লসেন। 

এমন ওপেনিংয়ে বিভ্রান্ত রাজীব ঘোড়া বের করলেন শুরুতে। কিন্তু ম্যাচটা ধরতে পারেননি কখনোই। তাঁকে কোনো সুযোগও দেননি কার্লসেন। রাজীব পেছনে তাকিয়ে সেটাই বলেছিলেন, ‘ওর প্রথম চাল দেখেই অবাক হয়ে ভাবছিলাম, আজ কী ভেবে ও এই চাল দিল!’ মিডল গেমে যেতে যেতে কার্লসেন পুরো নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন খেলাটা। কার্লসন খেলেছিলেন বিশ্বসেরার মতোই।

এটা ভেবেই রাজীবের সমব্যথী হচ্ছেন আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। তাঁর ভাষায়, ‘কার্লসেন ওই দিন অসম্ভব ভালো খেলেছে।’ ভালো যে খেলবেন, তা নিয়ে সংশয় ছিল না পাশের বোর্ডে থাকা গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদেরও। ধরেই নিয়েছিলেন, এক নম্বর বোর্ড থেকে পয়েন্ট আসবে না। প্রতিপক্ষ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, পয়েন্টের আশা কীভাবে করেন!

২০০৮ তুরিন অলিম্পিয়াডে কার্লসেনকে প্রথম দেখেন রাজীব, প্রথম আলাপও তখন। এবার অবশ্য কথাবার্তা হয়নি। খেলার বাইরে খুব একটা দেখাই হয়নি। আর খেলার সময় কি আর কথা হয়! কথাবার্তা না হলেও বিশ্বসেরার সঙ্গে খেলার আনন্দই আলাদা, সে যে খেলারই হোক। রাজীবও ব্যতিক্রম নন, ‘কী খেললাম, সেটা বড় কথা নয়। খেলার অভিজ্ঞতাই বিশাল প্রাপ্তি। আমাদের মতো দাবাড়ুদের কাছে এটা স্বপ্নের ম্যাচ।’

রাজীব যে বাড়িয়ে বলেননি, সেটার প্রমাণ মেলে নিয়াজের মতো দাবাড়ুর এখনো ২৮০০ রেটিংয়ের কাউকে প্রতিপক্ষ হিসেবে না পাওয়া। সর্বোচ্চ সাড়ে ২৭০০ রেটিংয়ের দাবাড়ুর সঙ্গে খেলেছেন। জিয়া নাইজেল শর্টসহ অনেককেই পেয়েছেন সামনে। ২০০৮ সালে সেরা পাঁচে থাকা কার্লসেনের সঙ্গে খেলে তাঁর ড্র আছে। তখন কার্লসেনের রেটিং ছিল ২৭৮৪। ২০১২ সালে ২৮০০-এর বেশি রেটিংয়ের প্রতিপক্ষ হিসেবে পান আর্মেনিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টার অ্যারোনিয়ানকে (২৮২০)। বেশ কয়েকজন চ্যালেঞ্জারকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেলেও বিশ্বসেরার সঙ্গে খেলার সুযোগ না পাওয়ার অতৃপ্তি আছে জিয়ার, ‘অবশ্যই বিশ্বসেরার সঙ্গে খেলতে চাই। সেই অপেক্ষাতেই আছি।’

গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন না হোক, এক সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছেন বছর কুড়ি আগে ভারতে। পঞ্চাশের দশকের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভ্যাসেলি স্মাইলভের সঙ্গে ওই স্মরণীয় ম্যাচটা ড্র করেছিলেন রিফাত।

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা সাধারণত ওপেন টুর্নামেন্টে খেলেন না বলেই তাঁরা ২৪০০ বা ২৫০০ রেটিংয়ের গ্র্যান্ডমাস্টারদের কাছে আকাশের তারা। কিন্তু কার্লসেন আলাদা, অলিম্পিয়াডে খেলেন। রাজীব আজীবন মনে রাখার মতো ওই সুযোগটা পেলেন সেই সুবাদেই। তাই কাসপরভের সঙ্গে তুলনা টানতে পারছেন কার্লসেনের, ‌‌‘কাসপারভ আক্রমণাত্মক খেলতেন বেশি। মিডল গেমে ছিলেন দুর্দান্ত। কার্লসেন এন্ড গেমে। ও ওপেনিং নিয়ে অত ভাবে না।’

সেই কার্লসেন রাজীবের সঙ্গে ম্যাচ শেষ করে নিয়াজের পেছনে এসে দাঁড়ান সেদিন। ম্যাচের সময় কোনো খেলোয়াড়ের পেছনে দাঁড়ানো নিষেধ। বাংলাদেশ তা লক্ষ করলেও বাধা দেয়নি কার্লসেনকে। ‘আমাদের নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেন তৈয়বুর রহমানকে ম্যাচ শেষে বললাম, আমার পেছনে দাঁড়াতে দিলে কেন কার্লসেনকে? ও বলল, “কীভাবে না বলি বলেন। বিশ্বসেরা দাবাড়ুকে কি তা বলা যায়!” দেশে ফিরে ম্যাচটা নিয়ে মজা করছিলেন নিয়াজ। নরওয়ের সঙ্গে ওই বড় ম্যাচে নিয়াজ জিতেছেন, রাকিব সে দেশের দ্বিতীয় সেরার সঙ্গে ড্র করেছেন। ১৮০টি দেশের মধ্যে পঞ্চম হওয়া নরওয়ের সঙ্গে ২.৫-১.৫ পয়েন্টে বাংলাদেশের হার। দারুণ ফলই বলতে হবে!

তবে এর আগ পর্যন্ত মোটামুটি ভালো খেললেও শেষ ম্যাচে কাতারের কাছে হেরে বাংলাদেশ এবার নিজেদের ইতিহাসের সর্বনিম্ন ৭৬ নম্বরে নেমেছে। এই দাবা অলিম্পিয়াডের কথা তাই ভুলে যেতে পারলেই ভালো। তবে রাজীব মনে হয় না তাতে রাজি হবেন! বিশ্বসেরার সঙ্গে খেলার স্মৃতি কি কেউ ভুলতে চায়, না ভুলতে পারে!

কার্লসেন বনাম রাজীব

১. e3 Nf6

২. Nf3 e6

৩. c4 b6

৪. Nc3 Bb7 ৫. d4 Bb4

৬. Bd3 Ne4 ৭. O-O Bxc3 ৮. bxc3 O-O ৯. Ne1 c5

১০. f3 Nf6 ১১. e4 Ne8 ১২. d5 d6

১৩. Nc2 Nd7 ১৪. Ne3 Nef6 ১৫. a4 a5

১৬. Ra2 Qc7 ১৭. f4 exd5 ১৮. exd5 Rfe8 ১৯. g4 Nf8 ২০. g5 N6d7 ২১. h4 Rad8 ২২. h5 Bc8 ২৩. Ng4 Re7 ২৪. Rg2 Kh8 ২৫. Qf3 Rde8 ২৬. Qg3 Rd8 ২৭. Bd2 Rde8 ২৮. f5 Ne5 ২৯. Nxe5 Rxe5

৩০. Bf4 Nd7 ৩১. f6 g6

৩২. hxg6 fxg6 ৩৩. Bxg6...

...কালোর হার স্বীকার

খেলা

বিবিধ