স্মৃতিতে ইলা মিত্র

ইলা মিত্র [১৮ অক্টোবর ১৯২৫-১৩ অক্টোবর ২০০২]
ইলা মিত্র [১৮ অক্টোবর ১৯২৫-১৩ অক্টোবর ২০০২]

নাচোলের কৃষকেরা রানীমা রানীমা ডাক তোলে

মেয়েটি হঠাৎ দেখে তুমি এলে!

ভগ্ন শরীর আর কঠিন নেত্র

সেই তুমিই ছিলে তার রানীমা ইলা মিত্র

ইলা মিত্রকে নিয়ে লেখা আমার কবিতার শেষ কয়েকটি লাইন। যখন ভাবি যে আমি ইলা মিত্রকে দেখেছি, নিজেকে খুব সৌভাগ্যবতী মনে হয়। এমন একজন মানুষকে একনজর দেখতে পাওয়া ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্ত। তখন আমি ছিলাম খুবই ছোট।

১৯৯৬ সালের ৭ নভেম্বর দুপুর। নাচোলের ডিগ্রি কলেজ মাঠে তেভাগা আন্দোলনের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইলা মিত্র এসেছিলেন। আমাদের বাড়ি থেকে নাচোল কলেজের দূরত্ব হেঁটে তিন থেকে চার মিনিট। আমার মনে পড়ে আমরা পাঁচ থেকে ছয়জন বন্ধুবান্ধবী বাড়ির সামনে খেলছিলাম। রাস্তা দিয়ে লাইন ধরে হাজার হাজার মানুষ যেতে দেখে খেলা বাদ দিয়ে কলেজ মাঠে গেলাম। আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। বর্ণিল সাজে সেজেছিল সেই কলেজ মাঠ। সেদিন পুরো বাংলাদেশ থেকে আদিবাসী সাঁওতালেরা ইলা মিত্রকে দেখতে এসেছিল। আমি একটা বিষয় ভেবে অবাক হই যে আমার মতো দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়া একটি মেয়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষের ভিড়েও ইলা মিত্রকে দেখতে পেয়েছিল। এর কারণ ছিল একটাই, তা হলো খুবই সুশৃঙ্খলভাবে ও লাইন ধরে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোনো স্বেচ্ছাসেবী ছিল না। সবাই দাঁড়িয়ে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে মনোযোগের সঙ্গে ইলা মিত্রের কথা শুনেছিলেন। সেদিনে ইলা মিত্রকে দেখার জন্য নাচোল ডিগ্রি কলেজ মাঠে মানুষের ঢল নেমেছিল। সেই ঢলের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। আমার যত দূর মনে পড়ে, আমি সামনের সারিতেই ছিলাম। যে জিনিসটি এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে, সেটি হলো, লাল পাড়ের হলুদ শাড়িতে আদিবাসী সাঁওতাল নারীরা ঢোলের তালে তালে তাঁদের সাঁওতালী নাচ পরিবেশন করছিলেন। অন্য রকম এক আনন্দঘন পরিবেশ ছিল তখন। কোনো রকম বিশৃঙ্খলা ছিল না। সেদিন সবাই ছিল সবার। ইলা মিত্রকে যেন দেখা যায়, সে রকম সুযোগ করে দিচ্ছিল সবাই সবাইকে।

ইলা মিত্র তখনো এসে হাজির হননি। সবাই তখন সাঁওতালী নাচ উপভোগে মগ্ন ছিল। বহু প্রতীক্ষার পর হঠাৎ একটি হর্ষধ্বনি শোনা গেল এবং দেখলাম, সবার মুখ খুশিতে ঝলমল করছে। তার কিছুক্ষণ পর দেখি একজন সাদা শাড়ি পরা নারী মঞ্চে এসে হাজির হলেন। যাঁকে দেখামাত্র উপস্থিত সাঁওতাল আদিবাসী কৃষকেরা খুশিতে ফেটে পড়লেন। দেখা গেল, সবাই হাততালি দিচ্ছে এবং সবার মুখে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ইলা মিত্র মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রণাম করার ভঙ্গিতে হাত দুটো এক করে দাঁড়ালেন। প্রায় দেড় লাখ মানুষ যেন দুর্লভ কিছু হাতের মুঠোয় পেল। তাদের সবার চোখেমুখে ছিল বাঁধভাঙা আনন্দ, যেমনটি আমার চোখেও ছিল। তখন বুঝতাম না, কেন মানুষ এত খুশি হয়েছিল। কিন্তু এখন জানি, সেই লাখো মানুষ কেন এত আনন্দিত হয়েছিল। কালো পাড়ের সাদা শাড়ি পরা ইলা মিত্রকে দেখেছিলাম। ইলা মিত্র মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, কিন্তু কী বলেছিলেন, তা আমার মনে নেই। কলেজ মাঠের বর্ণিল পরিবেশ ও মানুষের ভিড় এরই মধ্যে মঞ্চে সাদা শাড়ি পরা ইলা মিত্রকে একনজর দেখাটাই তাঁর সঙ্গে আমার স্মৃতিময় ঘটনা। তখন বলতে গেলে কিছুই বুঝতাম না। জ্ঞান হওয়ার পর তাঁর সম্পর্কে সবকিছু জেনেছি ও বুঝেছি।

সেলিনা হোসেনের কাঁটাতারে প্রজাপতি উপন্যাসটি নাচোলের তেভাগা আন্দোলনকে ঘিরে রচিত হয়েছে। এই উপন্যাসে ‘আজমল’ নামের একটি চরিত্র আছে, যিনি ইলা মিত্রের জবানবন্দিটি অনেক কষ্টে পড়ে শেষ করেছিলেন এবং ইলা মিত্র সম্পর্কে তাঁর উক্তিটি ছিল এ রকম: ‘পৃথিবীতে পবিত্র কিছু যদি থেকে থাকে, তবে ইলা মিত্র আমার কাছে সেই পবিত্র কিছু।’ কেউ আমাকে ইলা মিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে আমিও একই উক্তি করব।

ইলা মিত্রকে আমি আর কখনো দেখতে না পেলেও তাঁকে হূদয়ের সর্বোচ্চ আসনে বসিয়ে রেখেছি।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার রানীমা আমার হূদয়ের রানীর আসনেই থাকবেন।