স্মৃতির ডালি মেলে মামুন জোয়ারদার

মামুন জোয়ারদার
মামুন জোয়ারদার

মামুন জোয়ারদারকে মনে আছে? মনে আছে, মাথা নিচু করে দ্রুতগতিতে ড্রিবলিং করে প্রতিপক্ষকে কাঁপিয়ে দেওয়া তাঁর সেই স্টাইল? বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালি সময়ের শেষ প্রতিনিধিদের অন্যতম চুয়াডাঙ্গার সেই মামুন ফুটবলকে ‘বিদায়’ বলেছেন ১৩ বছর আগে। ২০০০ সালের এই আগস্ট মাসেই ঢাকার মাঠ থেকে তাঁর অশ্রুসিক্ত বিদায় কাঁদিয়েছিল ফুটবলামোদীদের। টানা সাত বছর জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা মামুন সেদিন বিদায় নিয়েছিলেন একরাশ বেদনা আর না পাওয়ার কষ্ট বুকে চেপে। সেই কষ্ট, সেই বেদনা ফুটবলে দেশকে বড় কোনো সাফল্য উপহার দিতে না পারার। সেই কষ্ট মামুনকে তাড়িয়ে বেড়ায় এখনো, ফুটবল ছাড়ার এত বছর পরও। মামুন জোয়ারদার এখন কানাডাপ্রবাসী। উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছেড়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। প্রথম আলো ডটকমের সঙ্গে একান্ত টেলিফোন আলাপে তিনি জানান, বিদেশে থাকলেও দেশের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন নন তিনি। এই তো কিছু দিন আগেও দেশ থেকে ঘুরে গেলেন। নিয়মিত দেশের ফুটবলের খোঁজখবর রাখেন। চুয়াডাঙ্গা জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও রয়েছে তাঁর সম্পর্ক। নিজের চিরপরিচিত ফুটবলপাড়ায় ঢুঁ মেরেছেন। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেলা দেখতে গিয়ে দারুণ হতাশ হয়েছেন তিনি। নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের শুরুর সময়ের সঙ্গে তো কোনো তুলনাই হয় না। দেশের ফুটবলের জনপ্রিয়তার অবস্থা তাঁর মতে, এখন ১০-১২ বছর আগের অবস্থানেও নেই। এককালের জমজমাট ফুটবলের এই করুণ দশা দেখে যারপরনাই হতাশ তিনি, ‘স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আবাহনীর একটি খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। গিয়ে প্রচণ্ড হতাশ হয়েছি। খেলাটা পুরোপুরি না দেখে চলে এসেছি। গ্যালারির দিকে তাকিয়ে দর্শকদের হাতে গোনা যাচ্ছিল। ফুটবলকে এই অবস্থায় দেখব, কোনোদিন ভাবিনি।’

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বয়সভিত্তিক একটি বাছাই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ফুটবলে আবির্ভাব মামুনের। এর আগে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা তো ছিলই। চুয়াডাঙ্গার জল-আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা মামুন ঢাকায় এলেই চলে যেতেন স্টেডিয়ামপাড়ায়। মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্সের মতো বড় ক্লাবগুলোর গেটের গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থেকে স্বপ্নের তারকাদের কাছ থেকে দেখে প্রীত হতেন। মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনতেন একদিন তারকা হবেন। গ্যালারিভর্তি দর্শককে তিনি উন্মাতাল করে দেবেন নিজের ফুটবলশৈলী দিয়ে। সেই স্বপ্ন তাঁর পূরণ হয়েছে। তিনি আবাহনীতে খেলেছেন। খেলেছেন মোহামেডানেও। জাতীয় দলের অপরিহার্য খেলোয়াড় হিসেবে তিনি হয়েছেন দেশের মানুষের প্রত্যাশার নায়ক। গোল করে বিদেশের মাটিতে দেশকে জিতিয়েছেন। তার পরও আফসোস তাঁর। খেলোয়াড় হিসেবে দেশকে বড় সাফল্য এনে দিতে পারেননি। এশীয় পর্যায় দূরের ব্যাপার, সাফ গেমসের সোনাও উপহার দিতে পারেননি দেশকে, ‘খুব আফসোস হয়। মাঝেমধ্যে নিজেকে অপরাধীও মনে হয়। তিনটি সাফ গেমস খেলেছি। দেশকে সোনা এনে দিতে পারিনি। আমাদের পরের প্রজন্ম সাফ গেমসে সোনা অবশ্য এনে দিয়েছে। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

আশি-নব্বইয়ের দশকে সাফ সোনাটা দেশ পেয়ে গেলে দেশের ফুটবলের চেহারা অন্যরকম হতো বলেই অভিমত মামুনের, ‘সাফ গেমসের সোনাটা পেয়ে গেলে আমরা ফুটবল নিয়ে অন্য মাত্রায় ভাবতে পারতাম। কিন্তু তা করতে পারিনি। এই আফসোসটা আমার কোনোদিন যাবে না।’

ফুটবলের বর্তমান অবস্থার জন্য ফুটবল সংগঠক ও ক্লাব, এমনকি সাবেক খেলোয়াড়দেরও সমানভাবে দায়ী করতে চান মামুন। তাঁর সময়ে পেশাদারির মারাত্মক অভাবই ফুটবলকে এই জায়গায় নামিয়েছে বলে মনে করেন মামুন। একই সঙ্গে ফুটবলে রাজনীতির কালো প্রভাব সর্বনাশের কারণ হয়েছে বলে অভিমত তাঁর।

‘ভাই, রাজনীতিই আমাদের ফুটবলকে শেষ করে দিয়েছে। সত্তর, আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে আমাদের ফুটবলে অনেক ভালো মানের খেলোয়াড় ছিলেন। আমরা শুরুর দিকে এমন খেলোয়াড়দের দেখেছি, যাঁদের সঙ্গে আমাদের কোনো তুলনাই হয় না। কিন্তু পেশাদারির অভাব। সুষ্ঠু পরিকল্পনার ঘাটতি, অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ব্যর্থতা আজকে ফুটবলকে এ অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। জাতীয় দল নির্বাচনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দেখেছি। আমাদের সময়ে জাতীয় দলের কোচদের অবস্থা ছিল ঠুঁটো জগন্নাথের মতো। তাঁরা নামমাত্র দায়িত্ব পালন করতেন। দল তৈরি হতো ওপরের মহলে। ক্ষমতাসীন দলের প্রিয় ক্লাবের খেলোয়াড়দের আধিক্য থাকত জাতীয় দলে। ফর্মে তাঁরা থাকুন আর নাই থাকুন, তাঁদের একাদশে খেলাতে বাধ্য হতেন কোচরা। এসব কারণেই জাতীয় দল কখনোই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায়নি।’ কথাগুলো বলে টেলিফোনের অপর প্রান্তে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস পড়ল মামুনের। ওই নিঃশ্বাসটির সঙ্গে মিশে ছিল চোখের সামনে প্রিয় খেলাটির অপমৃত্যু অবলোকন করা একজন খেলোয়াড়ের হাহাকার।

এই প্রতিবেদককে নিজের খেলোয়াড়ি জীবনে দেখা রাজনৈতিক নোংরামির বেশ কিছু কাহিনিও শুনিয়েছেন মামুন। ১৯৯৩ সালে জাপান-আমিরাতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ দলের স্কোয়াডে চারজন গোলরক্ষককে নিতে হয়েছিল শুধু দেশের বড় দুই ক্লাবের দড়ি টানাটানির জের ধরে। অথচ এ ধরনের স্কোয়াডে দুজন গোলরক্ষক যথেষ্ট। তত্কালীন ক্ষমতাসীন দলের চাপে ওই সফরে দিশেহারা ছিলেন কোচ কাজী সালাউদ্দিন। ফর্মহীন এক গোলরক্ষককে প্রথম ম্যাচে তত্কালীন এশীয় চ্যাম্পিয়ন জাপানের বিপক্ষে মাঠে নামিয়ে গোল-বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছিল জাতীয় দলকে। টোকিওর ওই ম্যাচে জাপান ৮-০ গোলে বাংলাদেশকে হারিয়েছিল।

এমন কয়েকটি কাহিনি একরাশ দুঃখ নিয়ে বললেন মামুন, ‘১৯৯৩ সালে আমি ছিলাম দারুণ ফর্মে। অথচ জাপান-আমিরাতে আমাকে সালাউদ্দিন ভাই মাঠে নামাতে পারতেন না। সেবার আমি থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ভরাডুবির মধ্যে একটি গোল করেছিলাম। সালাউদ্দিন ভাই বলতেন, “মামুন এই দল আমার না। এটা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া দল।”’

ফুটবলের কথিত ‘স্বর্ণ সময়ে’ সিনিয়র ফুটবলারদের উচ্ছৃঙ্খলতাও খুব কাছ থেকে দেখেছেন মামুন, ‘জাপানেই তো, ম্যাচের আগের দিন সারারাত সিনিয়ররা হোটেলে নেই। সকালে ঢুলতে ঢুলতে তাঁরা হোটেলে ঢুকেছেন। ক্লান্ত চেহারা নিয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে মাঠে নেমেছেন। পেশাদার যুগে এমন অবিশ্বাস্য সব ঘটনার সাক্ষী আমাদের অভাগা ফুটবল।’

ঘরোয়া ফুটবলে নিজের স্মরণীয় ম্যাচটি পুরো সময় খেলেননি মামুন। সেটা নিয়েও মজার গল্প শোনালেন সাবেক এই লেফট উইঙ্গার, ‘১৯৯২ সালের লিগ শিরোপা-নির্ধারণী ম্যাচে মুখোমুখি হয় আবাহনী-মোহামেডান। পুরো মৌসুমেই আমি আবাহনীর হয়ে দুর্দান্ত খেলেছিলাম। মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে কথা রটে গেল মোহামেডানের সঙ্গে আমার গোপন সম্পর্ক রয়েছে। কী ভয়াবহ কথা! চিন্তা করুন। কর্মকর্তাদের চাপে আবাহনীর সালাউদ্দিন ভাই আমাকে প্রথম একাদশে রাখলেন না। প্রচণ্ড দুঃখ পেলাম। আমার জায়গায় খেলল রাশিয়ান ফুটবলার আলেকজান্ডার পালিনকভ। সাইড বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতেই মোহামেডান ১-০ গোলে এগিয়ে গেল। মনের মধ্যে জেদ পুষে রেখেছিলাম। নিরুপায় হয়েই বোধ হয় আমাকে মাঠে নামালেন সালাউদ্দিন ভাই। নেমেই দুটি গোল করি, ১৫ মিনিটের ব্যবধানে। আবাহনী শিরোপা জয় করে। এই ম্যাচ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ম্যাচ।’

মামুনের জীবনের অন্যতম বড় দুঃখ মালয়েশিয়ার পেশাদার লিগের একটি দলে সুযোগ পেয়েও খেলতে না পারা, ‘কী বলব ভাই, ১৯৯৭ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেলতে মালয়েশিয়ায় গিয়ে সে দেশের ভালো একটি ক্লাব থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলাম। কিন্তু খেলতে পারিনি। আবাহনীর তত্কালীন কর্তারা আমাকে খেলতে অনুমতি দেননি। আবাহনীর প্রভাবে ওই সময় বাফুফেও আমাকে ছাড়পত্র দিতে পারেনি।

মালয়েশিয়ায় পেশাদার ফুটবল খেলতে না পারার মূল কারণ হিসেবে তিনি দেশের ক্লাব-রাজনীতিকেই দায়ী করেন, ‘ওই সময় আবাহনীর কর্মকর্তারা হয়তো ভেবেছিলেন মালয়েশিয়ায় খেলতে গেলে আমাকে তাঁরা ঢাকা লিগে পাবেন না। কিংবা মালয়েশিয়ার লিগে খেলে আসার পর যদি আমার টাকার চাহিদা বেড়ে যায়! এমনই কিছু ভাবনা হয়তো তাঁদের মাথায় ছিল। কিন্তু ব্যাপারটিতে আখেরে ক্ষতি হয়েছে দেশের ফুটবলেরই। শুধু আমি না, আমাদের সময় অনেকেই বিদেশি লিগে খেলার প্রস্তাব পেয়েছেন। ক্লাবগুলো তাঁদের যেতে দেয়নি। মুন্না ভাই, রুমি, সাব্বির, জুয়েল রানা অনেকেই মালয়েশিয়া, কোরিয়ার মতো ফুটবল লিগ থেকে প্রস্তাব পেয়েছেন। কিন্তু খেলতে পারেননি।’

জার্মান কোচ অটো ফিস্টারের অধীনে খেলতে পারাটা খেলোয়াড়ি জীবনের পরম পাওয়া হিসেবেই দেখেন মামুন, ‘ফিস্টার আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। তাঁর মতো উঁচুমানের কোচ বাংলাদেশে আর আসবে না। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা ফিস্টারকে রাখতে পারিনি। তিনিও এ দেশের ফুটবলে নোংরা রাজনীতির শিকার।’

১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে চারজাতি ফুটবলের শিরোপা বাংলাদেশ জিতেছিল ফিস্টারের প্রশিক্ষণেই। ফাইনালে মিয়ানমারের বিপক্ষে ২-১ গোলের জয়ে মামুনের আছে অন্যতম অবদান। নকিবের পাশাপাশি সেই ম্যাচে জয়সূচক গোলটি এসেছিল মামুন জোয়ারদারের পা থেকেই।

মিয়ানমারের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার ফিস্টারের প্রসঙ্গই টেনে আনলেন মামুন, ‘আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, সেই প্রতিযোগিতার প্রথম ম্যাচে মিয়ানমারের কাছে ৪-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। ওই ম্যাচেই ফিস্টার দলের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে ফেলেছিলেন। সেই অনুযায়ী পরের দুটো ম্যাচে (সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে) ফরমেশন পরিবর্তন করে আমরা সাফল্য পাই। ফাইনালে মিয়ানমারের সঙ্গেও আমরা ছিলাম পুরোপুরি পরিবর্তিত একটি দল।’

১৯৯৩ সালের সাফ গেমসে বাংলাদেশ দলের কোচ ওল্ডরিখ সোয়াবের একটি কথা আজও কানে ভাসে মামুনের, ‘সাফ গেমসে সোয়াব মনমতো দল সাজাতে পারেননি। নানামুখী চাপে একেবারে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মোনেম মুন্না কিংবা রুমির মতো খেলোয়াড়দের দলে রেখে রাজনৈতিক চাপে ওই দলের অধিনায়ক করতে হয়েছিল আরিফ হোসেন মুনকে। মুন নেপালের বিপক্ষে বক্সের মধ্যে ভুল পাস দিয়ে দলকে ডুবিয়েছিল। সোয়াব পরে বলেছিলেন, এই দেশে যত দিন ফুটবলে রাজনীতি থাকবে, তত দিন বাংলাদেশ কিছুই করতে পারবে না। এখন বুঝতে পারি সোয়াবের ওই মন্তব্যটি কতটা সঠিক ছিল।’

এই মুহূর্তে কানাডায় নির্বিরোধী, ছিমছাম জীবন যাপন করছেন মামুন জোয়ারদার। দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক মামুনের চিন্তাজুড়ে এখন ছেলেমেয়েদের কল্যাণ, ‘কানাডায় না এলে দেশেই ভালোভাবে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এখনো মনে হয় দেশে ফিরে যাই। কিন্তু ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে পিছিয়ে আসি। প্রবাসী জীবনটা একেবারে মন্দ কাটছে না আমার।’

ফুটবলের কাছে অনেক ঋণ মামুনের। এ কথা অকপটেই বললেন মামুন, ‘ফুটবল তো আমাকে সব দিয়েছে। অর্থ, খ্যাতি, যশ—সবকিছুই। ফুটবলের জন্যই তো আমাকে আপনারা চেনেন। ফুটবলকে সব সময়ই চাই কিছু ফিরিয়ে দিতে। দূর পরবাসে থেকে দেশের ফুটবলের জন্য সব সময়ই থাকে আমার শুভকামনা।’