ঠিকানা বা আশ্রয় বলতে কিছুই ছিল না ইতি আক্তারের। থাকত হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকার ফুটপাতে। নেশায় আসক্ত হয়ে একসময় ছোটখাটো অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ে। সেই কিশোরী ইতিই এখন পুরোপুরি বদলে গেছে, স্বপ্ন দেখে ফুটবলার হওয়ার।
৮-১৫ অক্টোবর কাতারে অনুষ্ঠেয় পথশিশুদের বিশ্বকাপ ফুটবলে ইতি খেলবে বাংলাদেশের হয়ে। পথশিশুদের বিশ্বকাপে এবার অংশ নেবে ২৪ দেশের ২৮টি দল। টুর্নামেন্টে খেলতে ৬ অক্টোবর ঢাকা ছাড়বে বাংলাদেশের মেয়েরা।
বাংলাদেশ দলে ইতি ছাড়াও খেলবে জেসমিন আক্তার, জান্নাতুল ফেরদৌস, হামিদা আক্তার, সাথী আক্তার, মীম আক্তার, আফরিন খাতুন, ফাইরুজ আবিদা, তানিয়া আক্তার ও তাহমিনা আক্তার। বিশ্বকাপের ভেন্যু আর রাইয়ানের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম।
বাংলাদেশের পথশিশু দলের মেয়েদের সবার জীবনের গল্পই সংগ্রামের। ফুটবল দিয়ে তারা ভুলতে চায় ধূসর অতীত। ফুটবল দিয়েই রাঙাতে চায় ভবিষ্যৎ। অথচ তাদেরই একজন একসময় নেশায় আসক্ত হয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে পড়ে থাকত। নানা রকম নিপীড়নের শিকারও হতে হয়েছে। তবে এখন তাদের প্রত্যেকে ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্নে বিভোর। খুদে ফুটবলার হামিদা বলছিল, ‘মেসি, রোনালদোরা যে মাঠে খেলবে সেখানে খেলব, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না!’
এই দলের আরেকজনের বাড়ি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায়। বাবা-মা নেই। নানির কাছে বেড়ে ওঠা। সিনেমায় শুটিং করানোর কথা বলে কিছু লোক ঢাকায় আনে মেয়েটিকে। শেষ পর্যন্ত সেখানেও ঠাঁই হয়নি। মেয়েটিকে উদ্ধার করে আনে লিডো। বংশাল থানা থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় উদ্ধার করা আরেকজনও এখন ফুটবলার। গৃহকর্মীর কাজ করা এক কিশোরী অত্যাচার সইতে না পেরে পালিয়ে রাস্তায় নামে। কমলাপুরের রাস্তা থেকে কাউন্সেলিং করে লিডো তাকে আনে ঢাকার ওয়াশপুরের ‘পিস হোমে’। এই কিশোরীদের আরেকজন কমলাপুর রেলস্টেশনে পানি বিক্রি করত। বাবা-মায়ের খোঁজ না–জানা মেয়েটিরও আশ্রয় হয়েছে ‘পিস হোমে’।
ঢাকা শহরের হাজার হাজার পথশিশুর মধ্য থেকে এই দশজনকে বিশ্বকাপের জন্য বাছাই করেছে লিডো। তার আগে ইংল্যান্ডে পথশিশুদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের কার্যালয়ে এই মেয়েদের বিভিন্ন রকমের তথ্য পাঠাতে হয়েছে। যাচাই–বাছাই করে তাদের সুযোগ হয়েছে কাতার যাওয়ার।
পথশিশুদের সহায়তা করার জন্য গঠিত বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান লিডোর পুরো নাম লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। যেসব শিশুর থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, চিকিৎসার সুবিধার প্রশ্নই আসে না—তাদের ‘পিস হোমে’ নিয়ে পরিবার খুঁজে বের করার চেষ্টা করে প্রতিষ্ঠানটি। কারও পরিবার খুঁজে পাওয়া না গেলে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে।
পথশিশুদের বিশ্বকাপে খেলানোর পরিকল্পনাটা লিডোর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেনের। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মাধ্যমে আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও বিশ্বকাপে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। বাবা-মায়ের পরিচয় না থাকায় কারও কারও পাসপোর্ট তৈরিতেও ছিল জটিলতা। শেষ পর্যন্ত কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের কাতারগামী বিমানে ওঠাতে পারছেন, এতেই খুশি তিনি। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে গতকাল এ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ফরহাদ বলছিলেন, ‘আমাদের এই পর্যন্ত আসতে অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে। কেএফসি দিচ্ছে জার্সি, বিমান টিকিট ইউএস–বাংলার। এমন আরও অনেক সহায়তা দিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। মেয়েদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেই খুশি আমরা।’