মরক্কো কি হতে যাচ্ছে ‘ডার্ক হর্স’

মরক্কো ফুটবল দলের ভক্তদের উল্লাস। একে বিবেচনা করা হচ্ছে আরব বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে। মরক্কো-কানাডা ম্যাচ, আল থুমামা স্টেডিয়াম, কাতার, ১ ডিসেম্বর। ছবি: এএফপিছবি: এএফপি

মরক্কো কি পারবে কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখতে? পারবে কি প্রতিবেশী স্পেনকে হারিয়ে দিয়ে ইতিহাস রচনা করতে? মঙ্গলবারে ‘মঙ্গল’ কি ধরা দেবে আশরাফ হাকিমিদের ঘরে? সব প্রশ্নেরই উত্তর মিলতে যাচ্ছে আর অল্প সময় পর কাতারের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে।

মরক্কো ছয়বার বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। এর মধ্যে তারা এবার নিয়ে দুবার শেষ ১৬–তে নিজেদের জায়গা করে নিতে পেরেছে। সর্বশেষ গিয়েছিল তিন যুগ আগে ১৯৮৬ সালে পূর্ব জার্মানিকে হারিয়ে। সে হিসাবে এমন সময় মরক্কো শেষ ১৬–তে গিয়েছিল, যখন বর্তমান দলের কোনো সদস্যের জন্মই হয়নি। কারণ, চলতি বিশ্বকাপে তাদের ২৬ সদস্যের স্কোয়াডের সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় গোলকিপার মুনির, যাঁর বয়স এখন ৩৩।

চলতি কাতার বিশ্বকাপে এখনো হারের স্বাদ পায়নি আটলান্টিক মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরের কোলঘেঁষা উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কো। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে তারা ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করেছে। দ্বিতীয় ম্যাচে ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছে ফিফার বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বেলজিয়ামকে। আর গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে কানাডাকে ২-১ গোলে হারিয়েছে কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুইর দল।

ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ২২তম অবস্থানে আছে মরক্কো। আজ খেলতে যাওয়া স্পেনের অবস্থান সপ্তম। তবে এবারের আসরে পয়েন্ট টেবিলের দিকে তাকালে মরক্কো এগিয়ে, তাদের পয়েন্ট ৭। আর স্পেনের ৪। স্পেন নিজেদের প্রথম ম্যাচে কোস্টারিকাকে ৭-০ গোলে হারালেও দ্বিতীয় ম্যাচে ১-১ গোলে ড্র করেছে জার্মানির সঙ্গে। আর শেষ ম্যাচে তারা জাপানের কাছে ২-১ গোলে হেরেছে।

মরক্কো পাচ্ছে একক সমর্থন

আয়োজক দেশ হিসেবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রুপ পর্বে সুযোগ পাওয়া কাতারসহ মোট চারটি আরব দেশ এবারের বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। ইতিমধ্যে সৌদি আরব, তিউনিসিয়া ও কাতার বিদায় নিয়েছে। শেষ ১৬–তে যেতে পেরেছে শুধু মরক্কো। তাই আরব বিশ্বের অধিবাসীদের এখন একক সমর্থন তাদের প্রতি। যার প্রমাণ পাওয়া গেছে সর্বশেষ আল থুমামা স্টেডিয়ামে মরক্কো বনাম কানাডা ম্যাচে। গ্যালারি ভর্তি শুধু মরক্কোর জার্সি আর পতাকা। এই সমর্থকদের সবাই কিন্তু মরক্কোর অধিবাসী নন। বরং বেশির ভাগই ছিলেন অন্যান্য আরব দেশের নাগরিক।  

আরও পড়ুন
কানাডাকে হারিয়ে নকআউট পর্বে যাওয়া নিশ্চিত হওয়ার পর পিএসজি তারকা আশরাফ হাকিমিদের উল্লাস। আল থুমামা স্টেডিয়াম, কাতার, ১ ডিসেম্বর
ছবি: এএফপি

মাঠের খেলায় গ্যালারির দর্শকদের সমর্থন কতটা ভূমিকা রাখে, তা নিয়ে বিতর্ক নিশ্চয় রয়েছে। তবে খেলোয়াড়দের মনোবল চাঙা রাখতে দর্শক-গ্যালারির ভূমিকা যে একদম নেই, তা কিন্তু বলা যাবে না। আপাতত এটা চোখ বুঝে বলা যাচ্ছে, আজকের ম্যাচে স্টেডিয়ামের দর্শকসারিতে মরক্কোর সমর্থন থাকবে চোখে পড়ার মতো। এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা।

বুতাইনা এসসাদিকি নামের মরক্কোর এক সমর্থক আল-জাজিরাকে বলেন, দলটি পুরো জাতিকে একত্র করেছে। এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জন্ম নেওয়া মরক্কোর নতুন প্রজন্মও একই বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছে। তাদের এই সফলতা শুধু মরক্কোর জন্য নয়, পুরো আরব বিশ্বের ফুটবল ভক্তদের জন্য উজ্জ্বল এক আভা। স্পেনকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে পারলে এটি হবে পুরো আরব বিশ্বের জন্য বিজয়।

আমরা আশা করি, মঙ্গলবার বিশ্বকাপে মরক্কোর শেষ জাতীয় সংগীত বাজানো হবে না।
ইসমাইল ছোখমান, মরক্কোর নাগরিক

ইয়াসমিনা বেনানি নামের আরেক দর্শক বলেন, ‘এই দল মরক্কোর সব হৃদয়কে এক তালে স্পন্দিত করছে। তাদের এই অগ্রগতিতে গর্ব, উত্তেজনা, ভয় সবই ছিল—যা ১৯৮৬ সাল থেকে আমরা দেখিনি।’

মরক্কোর অধিবাসী তরুণী হোরিয়া আল-হাদাদ বলেন, ‘আমি অনুভব করি পুরো আরব বিশ্ব মরক্কো দলের সঙ্গে রয়েছে। তাদের এই ঐক্য সত্যি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। তারা যদি স্পেনকে হারাতে পারে, তাহলে এটা হবে পুরো আরব বিশ্ব ও আফ্রিকার বিজয়।’

কাতারের রাজধানী দোহায় কর্মরত ইবতিসাম আমজিল বলেন, ফল যা–ই হোক, শেষ পর্যন্ত তিনি মরক্কোর দলকে সমর্থক দিয়ে যাবেন।

‘টুর্নামেন্টের ডার্ক হর্স’

এই টুর্নামেন্ট শুরুর আগে, জর্ডানের কোচ আদনান হামাদ মরক্কোকে অভিহিত করেছেন ‘টুর্নামেন্টের ডার্ক হর্স’ হিসেবে। তাঁর ভাষ্য, এই বিশ্বকাপে আরব বিশ্বের সবচেয়ে ভালো দলটি হলো মরক্কো। এই দলে ইউরোপের লিগগুলোতে খেলা ২০ জন পেশাদার ফুটবলার রয়েছেন। তিনি আশা করেন, গ্রুপ পর্বের উড়ন্ত পারফরম্যান্স ১৬-তেই দেখাতে পারবে মরক্কো।

কাতারে বসবাস করা মরক্কোর নাগরিক কাওতার জিহফির বলেন, বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে স্পেনের সঙ্গে তাঁর দেশের ১৫ ধাপ পার্থক্য থাকলেও এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে এর ছাপ পড়বে না। তাঁর আশা, তাঁদের দল জয়ী হবে। এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই দলের কোচ ও খেলোয়াড়দের মধ্যে কেবল পেশাদারত্বই নেই, তাঁদের মধ্যে জয়ের এক আকুল তৃষ্ণাও রয়েছে। আমরা জানি, স্পেন একটি শক্তিশালী দল। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু দুর্বল দল নই।’

‘আমরা আশা করি, মঙ্গলবার বিশ্বকাপে মরক্কোর শেষ জাতীয় সংগীত বাজানো হবে না। এই বিশ্বকাপ আমাদের জন্য বিশেষ কিছু। কারণ, অন্যান্য ম্যাচে আমরা ৪০ হাজার মরোক্কানই জাতীয় সংগীতে কণ্ঠ মেলাইনি, আমাদের সঙ্গে অন্য আরব দেশের নাগরিকেরাও ছিলেন।’ বললেন মরক্কোর নাগরিক ইসমাইল ছোখমান।


আল–জাজিরা ও ফিফা ডটকম অবলম্বনে মো. ছানাউল্লাহ