বাল্যবিবাহ কিন্তু হয়েই যাচ্ছিল, তারপর...

বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দেওয়া ইতি এখন জাতীয় পর্যায়ের আর্চার। ছবি: শামসুল হক
বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দেওয়া ইতি এখন জাতীয় পর্যায়ের আর্চার। ছবি: শামসুল হক

কতই বা বয়স হবে তখন? ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত ইতি খাতুন। পাড়ার সাথিদের সঙ্গে পুতুল খেলেই সময়টা কেটে যেত বেশ। আরও একটা খেলার প্রতি ভীষণ টান ইতির। তির-ধনুকের খেলায় এতটাই মজে গিয়েছিল যে বাবা-মায়ের বকুনিকেও পরোয়া করেনি। অনুশীলন শেষে একদিন বাড়িতে এসে দেখে বাবা তাকে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। পাত্রপক্ষ বসাবাড়ির বারান্দায়। বিয়ের সব আয়োজন শেষ।

শাড়ি পরে ঘোমটা মাথায় পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ইতি। পাত্রপক্ষের পছন্দও হয়ে যায় ‘বালিকা বধূ’কে দেখে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসে ইতি। বিয়েটা আর হয়নি। বিয়ের আসর থেকে উঠে আসা মেয়েটাই কাল তীর নবম জাতীয় আর্চারিতে জিতেছে প্রথম পদক। তিরন্দাজ সংসদের হয়ে মেয়েদের রিকার্ভ ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পেয়েছে চুয়াডাঙ্গার কিশোরী।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) প্রতিভা অন্বেষণের আবিষ্কার ইতি। চুয়াডাঙ্গা স্টেডিয়ামে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আর্চারির প্রাথমিক বাছাইয়ে হয়েছিল প্রথম। চুয়াডাঙ্গার ঝিনুক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী এই প্রথম অংশ নিয়েছে জাতীয় আসরে। প্রথমবার বড় প্রতিযোগিতায় সুযোগ পেয়েই ব্রোঞ্জ জিতে ভীষণ খুশি ইতি।
বাবা ইবাদত আলী হোটেলের কর্মচারী। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। তিন মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। মেয়েদের স্কুলের খরচ জোগাতে পারেন না বেশির ভাগ সময়। মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সে জন্যই। কিন্তু সিদ্ধান্তটা যে কত বড় ভুল ছিল, ইবাদত আলী তা কাল নিজের চোখেই দেখলেন। মেয়ের খেলা দেখবেন বলে পরশু রাতে চুয়াডাঙ্গা থেকে এসেছেন টঙ্গীতে। কাল শেখ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামের লোহার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন গ্যালারিতে। মেয়ে পদক জেতায় ইবাদত আলীর মুখে গর্বের হাসি। মেয়েকে কেন এত কম বয়সে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? প্রশ্নটা করতেই লাজুক হেসে বললেন, ‘আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। একে তো গরিব, তার ওপর কীভাবে সংসার চালাব, ভেবে পেতাম না। মেয়েদের পেছনে অনেক খরচ হয়। তাই ভেবেছিলাম বিয়ে দিয়ে দিই। পরে ভুল বুঝতে পেরেছি। আর ও পথে পা বাড়াইনি।’
অনুশীলনে ভালো পারফরম্যান্সের সুবাদে জাতীয় দলের ক্যাম্পে সুযোগ পেয়েছে ইতি। এক বছর ধরে আছে আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামের ট্রেনিং সেন্টারের আবাসিক ক্যাম্পে। আর্চারি খেলার কারণে ক্লাব ও ফেডারেশন কিছু আর্থিক সাহায্য করেছে। টাকাগুলো এরই মধ্যে ইতি তুলে দিয়েছে বাবার হাতে। ইতির গলায় পদক দেখে খুশিতে আটখানা ইবাদত আলী বলছিলেন, ‘আমার এলাকার ঘরে ঘরে এখন একটাই কথা, ইবাদতের মেয়ে কোথায় গেছে তোমরা দেখো। একদিন কাজ না করলে সংসার চলে না। মেয়ে মেডেল জেতায় কী যে ভালো লাগছে বলে বোঝানো যাবে না।’
অথচ একটা সময় খেলতেই দিতে চাইতেন না মেয়েকে! পদক জয়ের পর ইতি সেই দুঃখের কথাগুলো শোনাচ্ছিল, ‘বাবা বলতেন, মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, কেন খেলবি? মা-বাবা কেউই আমাকে খেলতে দিত না। পড়াশোনাও করতে দিত না। ঢাকায় যখন জাতীয় দলের ক্যাম্পে আসার সুযোগ পেলাম, তখন কেউই পাঠাবে না। আমি রাগ করে দুই-তিন দিন আব্বু-আম্মুর সঙ্গে কথা বলিনি। পরে আব্বু রাজি হয়ে আমাকে ঢাকায় খেলতে পাঠান।’
অন্তত একটা পদক জয়ের আশা নিয়েই খেলতে এসেছিল ইতি। ইবাদত আলী যেন জানতেন সেটা, ‘আমি এখানে আসার পর ও আমাকে বলেছে, আব্বা একটা কিছু করতেই হবে।’ তবে এখানেই থেমে থাকতে চায় না ইতি। স্বপ্নটা দূরের বাতিঘরে, ‘আগে বাড়িতে দুবেলা ঠিকমতো খেতে পারতাম না। কিন্তু এখানে উন্নত পরিবেশে থেকে যেসব খাবার খাচ্ছি, সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি, সেটা কাজে লাগাতে চাই। আগামী এসএ গেমসে সোনা জিততে চাই আমি।’ বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে এরই মধ্যে একটা যুদ্ধে জিতে গেছে ইতি। এবার মাঠের লড়াইয়ে জিতে উঠতে চায় সোনার পদকের মঞ্চে।