বড়দের বড়াই করার দিন শেষ!

প্রথম ম্যাচেই আটকে গিয়ে মেসির মাথায় হাত। ছবি: এএফপি
প্রথম ম্যাচেই আটকে গিয়ে মেসির মাথায় হাত। ছবি: এএফপি
>

বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত ১১ ম্যাচ হয়ে গেল। স্বীকৃত চার বড় দল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি ও স্পেনের মধ্যে কেউ প্রথম ম্যাচটা জিততে পারেনি। অর্থাৎ ছোট ও বড় দলের মধ্যে পার্থক্য কমে আসছে

প্রিয় দলের খেলা তো দেখছেন। কেউ ব্রাজিল, কেউ আর্জেন্টিনা, কেউ আবার স্পেন কিংবা জার্মানির সমর্থক। এই বিশ্বকাপে এরাই স্বীকৃত বড় দল। তা, এসব দলের প্রথম ম্যাচ দেখার পর সমর্থকেরা কেমন বোধ করছেন? মাইলসের সেই গানের লাইনটির মতো—‘এক ঝড় এসে ভেঙে দিয়ে গেল...’

ভাঙলে আবারও সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায়। বড় দলগুলোর ক্ষেত্রে এ কথা বহুবার প্রমাণিত। তবে অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলো এই বিশ্বকাপে বড় দলগুলোকে ‘ক্লিশে’ হয়ে পড়া কথাটা আবারও প্রমাণের সুযোগ করে দিল!

আর্জেন্টিনার কথাই ধরুন। প্রথম ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল আইসল্যান্ড। খেলার ধারে-ভারে, গুণে-মানে, এমনকি জনসংখ্যার তুলনায়ও তারা আর্জেন্টিনার কাছে ‘শিশু’। আর বিশ্বকাপের কথা ধরলে তো ‘নবজাতক’—আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সেই ম্যাচটা দিয়েই তো বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে তাদের জন্ম হলো। তা, এই মঞ্চে জন্মেই দলটি আর্জেন্টিনার কাজ বাড়িয়ে দিয়েছে। ১-১ গোলের ড্রয়ে মেসিদের এখন আশার ভাঙা তরি মেরামতের চ্যালেঞ্জ।

সুইসদের বিপক্ষে পরিচিত ভঙ্গিতে নেইমার। ছবি: এএফপি
সুইসদের বিপক্ষে পরিচিত ভঙ্গিতে নেইমার। ছবি: এএফপি

মেক্সিকো অবশ্য আইসল্যান্ডের মতো ‘শিশু’ নয়। বিশ্বকাপ অভিজ্ঞতায় তারা ‘প্রবীণ’ হয়ে ওঠার পথে। যদিও তাদের পেছনের পথটা বিশ্বকাপে সত্যিকারের ‘প্রবীণ’ জার্মানির মতো অতটা সমৃদ্ধ নয়। তাই ধারে-ভারে সেভাবে ধরা হয় না। কিন্তু কাল জার্মানিকে বাগে পেয়ে তারা ‘ধরে’ দিয়েছে!

ওয়েস্টার্ন সিনেমায় কখনো মেক্সিকান ঘোড়ার দৌড় দেখেছেন? কাল ৯০ মিনিটের গতিময় ‘সিনেমা’য় মেক্সিকান ‘ঘোড়া’দের সঙ্গে জার্মান ‘পাঞ্জার’ (ট্যাংক) পারল কোথায়! ১-০ গোলে জার্মানির হারটা ফুটবল-ব্যাকরণে শুধুই ‘অঘটন’। কিন্তু মাঠে মেক্সিকানরা যে গতি আর দম দেখিয়েছে, তার সামনে জার্মানিকে সত্যিকারের ‘বুড়ো’ বলেই মনে হয়েছে। জোয়াকিম লো এ জন্য মেক্সিকোকে গোপনে একটা ধন্যবাদ দিতেই পারেন। সেটা প্রথম ম্যাচেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের কঙ্কাল বের করে আনার জন্য—আর তাই লোর সামনে সুযোগ এসেছে ভুল শুধরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর।

ওজিলের মতো জার্মানিকেও প্রথম ম্যাচে টেনে তোলার মতো কেউ ছিল না। ছবি: এএফপি
ওজিলের মতো জার্মানিকেও প্রথম ম্যাচে টেনে তোলার মতো কেউ ছিল না। ছবি: এএফপি

কিন্তু নেইমার প্রথম ম্যাচে নিজেকে সেই সুযোগ দিলেন কোথায়? চোট থেকে শতভাগ সুস্থ হয়ে না উঠলেও অন্তত ম্যাচ খেলতে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো ফিট ছিলেন। নইলে তিতে তাঁকে প্রথম একাদশের হয়ে মাঠে নামাতেন না। অথচ ব্রাজিল–সমর্থকদের অনুযোগ, নেইমার তো সুইস-নাইফের সামনে দাঁড়াতেই পারল না! হ্যাঁ, ফাউল তো হয়েছেই। প্রতিপক্ষ দলের সেরা খেলোয়াড়কে আটকাতে তো আর পুষ্প বিছানো রাস্তা বানানো যায় না! ইটপাটকেল রাখতেই হয়। এতে অবশ্য নেইমারের একটা সুবিধাও হয়েছে। বল পেলেই তাঁর একা খেলার কটু দৃশ্য ‘ফাউল বিতর্কে’ ঢাকা পড়ে গেছে।

ব্যাপারটা যেন এ রকম, নেইমার মাঠে বারবার চিতপটাং হয়েছেন বলেই সুইজারল্যান্ড ম্যাচটা হারেনি। সুইস–সমর্থকেরা অবশ্য ভিন্ন যুক্তি দিতে পারেন, ফুটবল তো এক অর্থে শরীরী-স্পর্শের খেলা। ইংরেজিতে যা ‘ফিজিক্যাল কনটাক্ট গেম’। তা, যে শরীরকে একটু শক্ত করে ছুঁলেই শুয়ে পড়ে তাঁর সোজা হয়ে দাঁড়ানোর কী দরকার? সিনা টানটান করে তো খেলেছেন সুইসরা। গোল ঠেকাতে গিয়ে প্রয়োজনে কড়া ট্যাকল আর আক্রমণে উঠে ভাঙো হলুদ-শিকল! এই কাজটা সারাক্ষণই করেছেন সুইসদের ‘ওঁরা এগারোজন’।

স্পেনকে একাই রুখে দেওয়া রোনালদো। ছবি: এএফপি
স্পেনকে একাই রুখে দেওয়া রোনালদো। ছবি: এএফপি

কিন্তু পর্তুগালের ছিলেন মাত্র একজন। তাঁর সামনে একসময়ের বিশ্বজয়ী স্প্যানিশ ‘আর্মাডা’। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কী অনুপম দক্ষতায় একাই তাঁদের রুখে দিলেন! সেই ম্যাচের আসল স্কোরলাইন তো স্পেন ৩—৩ রোনালদো। সেটা তাঁর হ্যাটট্রিকের জন্য নয়। দলে তারকা বলতে তিনি একাই। কিন্তু সেদিন গোলের সঙ্গে আক্রমণ কিংবা রক্ষণে রোনালদো একাই হয়ে উঠেছিলেন ‘দুধারী তলোয়ার’। আর তাতেই কাটা পড়েছে স্প্যানিশ তারকাসম্ভার। নিজেদের চেয়ে সব দিক থেকেই শক্তিশালী একটা দলকে যে একাই রুখে দেওয়া যায়, সেটা একসময় বাংলা সিনেমার পর মনে করিয়ে দিলেন রোনালদো।

মনে করিয়ে দিয়েছে স্বাগতিকেরাও। বিশ্বকাপের শুরুর দিনে সৌদিদের নিয়ে তারা যা করল! অথচ এই বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে র‍্যাঙ্কিংয়ে রাশিয়াই ছিল তলানিতে। ভালো করার খিদে আর বীরত্বই পারে এমন তলানি থেকে দেশকে তুলে আনতে। দলের হার এড়াতে যেমনটা দেখিয়েছেন রোনালদো। জয়ের লক্ষ্যে ঠিক একই কাজে ব্যর্থ হওয়া মেসির মুখটা ছিল দেখার মতো—কথাটা অবশ্য ব্রাজিল–সমর্থকদের জন্য। যার জবাবে আর্জেন্টাইন–সমর্থকেরা বলতে পারেন, নেইমারের মুখ দেখব কী, মাঠে সারাক্ষণ এমনভাবে পড়ে ছিল যে চাঁদবদন দেখাই গেল না!

বড়দের এত সব বিতর্কে কিন্তু লাভ হচ্ছে ছোটদের। তারা বড় হয়ে উঠছে। তাই বিশ্বকাপের মঞ্চে এখন আর ছোট দল বলে কিছু নেই!