সাম্পাওলির ট্যাকটিকসে সমস্যা যেখানে

ভীষণ চাপে রয়েছেন আর্জেন্টিনা কোচ হোর্হে সাম্পাওলি।
ভীষণ চাপে রয়েছেন আর্জেন্টিনা কোচ হোর্হে সাম্পাওলি।
কেন পারছে না আর্জেন্টিনা। সমস্যা আসলে কোথায়? খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন হাসান জামিলুর রহমান


কেউ বলছেন দল নির্বাচন ঠিকঠাক হয়নি, কেউ বলছেন সাম্পাওলিই যত নষ্টের গোড়া, কেউ এক ধাপ এগিয়ে সব দোষ চাপাচ্ছেন লিওনেল মেসির ঘাড়ে। 

আর্জেন্টিনার সত্যিকারের সমস্যা আসলে কোথায়? সাম্পাওলিই কি আসল অপরাধী? মেসির ব্যর্থতাতেই নিষ্প্রভ আর্জেন্টিনা। নাকি আছে অন্য কোনো সমস্যা?

ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে আর্জেন্টিনার বাজে পারফরম্যান্সের দায় নিজের কাঁধে নিয়েছেন হোর্হে সাম্পাওলি। নিজেই মেনে নিয়েছেন, বিপক্ষে তাঁর কৌশল ঠিক ছিল না, ‘আমার উচিত ছিল ম্যাচের গতিবিধি আরও ভালো করে বুঝে খেলার কৌশল ঠিক করা। তাহলে হয়তো আমরা এভাবে হারতাম না।’

ফুটবল কোচের খেলা। এখানে মাঠে অধিনায়কের ভূমিকা সামান্য। খেলা কখন কীভাবে হবে, এর পুরোটাই ডাগ আউট থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন কোচ। ফলে মূল দায়টা তো অবশ্যই তাঁর। সাম্পাওলি অবশ্যই ভুল করেছেন। খেলোয়াড় নির্বাচন থেকে শুরু করে কৌশল নির্ধারণ—কোনো ক্ষেত্রেই নিজের কাজটা সঠিকভাবে করতে পারেননি তিনি। সাম্পাওলির অধীনে আর্জেন্টিনা ১৩টি ম্যাচ খেলেছে, এই ১৩ ম্যাচে সাম্পাওলি কখনোই অভিন্ন একাদশ খেলাননি। প্রতিবারই বেছে নিয়েছেন নতুন একটি একাদশ! কোনো না কোনো পরিবর্তন দলে ছিলই!

তাঁর অধীনে খেলিয়েছেন ৫৯ জন খেলোয়াড়কে! সাম্পাওলির টিম ফরমেশন ৪-৪-২-এর মতো সরল নয় কখনোই। তাঁর ছক জটিল। তাঁর ফুলব্যাকরা কখনো কখনো ফুলব্যাকও নয়। এমনই জটিল সমীকরণ বুঝতে বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা পেয়েছেন হাইতির মতো একটি দলের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ আর নয়টি অনুশীলন সেশন! এর মধ্যে ইসরায়েল ম্যাচটি বাতিল হলো। বিকল্প দল খুঁজে পেল না আর্জেন্টিনা। খোদ লিওনেল মেসিকে দেখে মনে হচ্ছে, সাম্পাওলির ছক যেন তাঁর কাছে কোয়ান্টাম ফিজিকসের জটিল সূত্র। বুঝতে পারছেন না। বাকিরা তো আরও দুর্বল ছাত্র!

আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ড্রয়ের ওপর দিয়ে পার পেলেও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সাম্পাওলির কৌশলের দুর্বলতা প্রকট ছিল। মাঝমাঠে ছিল না কোনো দখল, আক্রমণভাগ ছিল নিষ্প্রভ, রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরা বুঝতেই পারছিলেন না কী করবেন। সাবেক আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ও বর্তমান অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কোচ ডিয়েগো সিমিওনে যেটিকে বলেছেন ‘সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা’।

সাম্পাওলির সঙ্গে আর্জেন্টিনার কোচ হওয়ার দৌড়ে সিমিওনেও ছিলেন। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের পর নিজের সহকারীকে একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠান সিমিওনে। যেটি ফাঁসও হয়ে যায়। সেই বার্তায় সিমিওনে বলেন, ‘আর্জেন্টিনা দলটি চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে। দলে কোনো নেতৃত্ব নেই, কোনো নেতাও নেই। কোচ কিংবা খেলোয়াড়দের কেউই সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসছে না।’

সাম্পাওলির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তাঁর কোনো প্ল্যান ‘বি’ নেই। লিওনেল মেসিকে কীভাবে ব্যবহার করবেন, কোন উপায়ে মেসির সেরাটা দেখা যাবে, সেটির উপায় বের করতে পারেননি সাম্পাওলি। সাম্পাওলি প্ল্যান বি-এর সেরা সুযোগ নিজেই নষ্ট করেছেন। দলে রেখেছেন প্রায় একই ধরনের দুই স্ট্রাইকার—গঞ্জালো হিগুয়েইন আর সার্জিও আগুয়েরোকে। আগুয়েরোকে প্রতিপক্ষ যে ছকে আটকাতে পারবে, হিগুয়েইনকে আটকানো যাবে একইভাবে। নতুন কিছু করার ঝুঁকি প্রতিপক্ষকে নিতে হবে না।

অথচ এখানে ভালো বিকল্প হতে পারতেন মাউরো ইকার্দি। ইকার্দি সেট পিসে বক্সের মধ্যে ভয়ংকর। পাসের পর পাস দিয়ে যখন প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভাঙা যায় না, তখন অস্ত্র হতে পারে উইং দিয়ে ক্রস করা। সমস্যা হলো, ক্রস কাজে লাগানোর মতো মাথা নেই আর্জেন্টিনার। ইতালিয়ান লিগের এই মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতাকেই যে রেখে এসেছে আর্জেন্টিনা!

আর্জেন্টিনা কোন ছকে খেলবে, আগেই বুঝে গিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপত্রও ছিল তাদের
আর্জেন্টিনা কোন ছকে খেলবে, আগেই বুঝে গিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপত্রও ছিল তাদের

চিলির কোচ থাকাকালীন যে কৌশল প্রয়োগ করেছেন, সেই একই কৌশলে আর্জেন্টিনাকেও খেলানোর চেষ্টা করছেন সাম্পাওলি। যেটি কোনোভাবেই কাজ করবে না। কারণ, সাম্পাওলির দর্শন অনুযায়ী খেলোয়াড়দের প্রচণ্ড পরিশ্রমী হতে হবে, পুরো ম্যাচে প্রত্যেক খেলোয়াড়কে প্রচুর দৌড়াতে হবে। যে দর্শনের সঙ্গে আর্জেন্টিনার এই দল পরিচিত নয়। গায়ে-গতরে খেলার ফুটবল কখনোই আর্জেন্টিনা পারে না।

আর্জেন্টিনার ফুটবল খেলার ধরনটাকে বলা হয় ‌‘পাউসা’। যার মূল অস্ত্র হলেন দলের প্লে-মেকার। তিনি ঠিক কোন মুহূর্তে ফাইনাল পাস দেবেন, সেটাই আর্জেন্টিনাতে শেখানো হয়। এই ঘরানার প্লে-মেকার সর্বশেষ আর্জেন্টিনা পেয়েছিল হুয়ান রোমান রিকেলমের মধ্যে। সাম্প্রতিক সময়ে রিকেলমের অভাব পূরণের মতো খেলোয়াড় আসেনি আর্জেন্টিনায়। ‌পাউসার তবু যে ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট ছিল, তা–ও যেন হারিয়ে গেছে এবারের বিশ্বকাপে।

ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচেই দেখা গেছে, কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই আক্রমণভাগে একের পর এক খেলোয়াড় বদলি করেছেন সাম্পাওলি। যাঁরা মাঠে নেমে তাঁদের কাজ কী, সেটাই যেন জানতেন না। খেলোয়াড়েরা শুধু দৌড়াচ্ছেন। উদ্দেশ্যহীন এই দৌড়। কে কাকে পাস দেবেন, সেই পাসের পরের পরিণতি কী, কেউ জানেন না!


দ্বিতীয় পর্বে পড়ুন:
মেসিই কি আর্জেন্টিনার সমস্যা?