বিশ্বকাপে ইরানি মেয়েরা

গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছেন ইরানের কয়েকজন নারী, যা এক নতুন অভিজ্ঞতা। ছবি: এএফপি
গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছেন ইরানের কয়েকজন নারী, যা এক নতুন অভিজ্ঞতা। ছবি: এএফপি
>গোটা ঘটনাটাই ঘটেছিল অবিশ্বাস্যভাবে কাজানের আজাদি স্টেডিয়ামে। দুরুদুরু বক্ষে যে ইরানের নারী সমর্থকেরা পুরুষদের সঙ্গে মিলে স্টেডিয়ামে ঢোকার সারিতে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা যে একটা অনানুষ্ঠানিক বিপ্লব করে বসলেন, এ খবর কজন মানুষ রাখে? দীর্ঘ ৩৭ বছর পর ইরানের নারীরা খেলা দেখার জন্য প্রকাশ্যে মাঠে ঢুকলেন!

 

রাশিয়ার কাজানে স্পেনের সঙ্গে ইরানের খেলাটি কি দেখেছিলেন আপনি? ১-০ গোলে সে খেলায় জিতেছিল স্পেন। কাজানের ‘আজাদি’ স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে খেলার শেষ বাঁশি বাজার পর সজল চোখে নিজ দেশকে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন ইরানি মেয়েরা। চোখের এই জল শুধু বেদনার নয়, আনন্দেরও। ভালো খেলেছে ইরান, এটা যেমন সেই আনন্দের কারণ, তার চেয়েও বড় কারণ হলো, বহুদিন পর ইরানি মেয়েরা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে খেলা দেখলেন। ইরানি বিপ্লবের পর এ তো এক মহা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

৯১ মিনিটব্যাপী সে খেলায় ইরানের ১৫ হাজার দর্শক নিজ দলকে সমর্থন করে গেছেন পুরোটা সময়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নারী দর্শকেরাও। ইরানে পুরুষদের ফুটবল স্টেডিয়ামে এসে খেলা দেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে নারীদের। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলের কয়েক মাস আগে থেকেই স্টেডিয়ামে এসে নিজ দলকে সমর্থন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন ইরানি নারীরা। সরকারের প্রতি তাঁরা আহ্বান জানাচ্ছেন এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য। রাশিয়া বিশ্বকাপের পর হয়তো সে নিষেধাজ্ঞা উঠেও যাবে, কিন্তু কবে, কখন সে মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে, সেটা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারে না।

গোটা ঘটনাটাই ঘটেছিল অবিশ্বাস্যভাবে কাজানের আজাদি স্টেডিয়ামে। দুরুদুরু বক্ষে যে ইরানের নারী সমর্থকেরা পুরুষদের সঙ্গে মিলে স্টেডিয়ামে ঢোকার সারিতে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা যে একটা অনানুষ্ঠানিক বিপ্লব করে বসলেন, এ খবর কজন মানুষ রাখে? দীর্ঘ ৩৭ বছর পর ইরানের নারীরা খেলা দেখার জন্য প্রকাশ্যে মাঠে ঢুকলেন! ১৯৮১ সালের পর পুরুষদের পাশাপাশি বসে খেলা দেখার এটাই প্রথম ঘটনা!

কাজানের আজাদি স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে নিজ দেশের খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিয়েছেন ইরানি নারীরা
কাজানের আজাদি স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে নিজ দেশের খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিয়েছেন ইরানি নারীরা

তবে এটা সহজ ছিল না। ইরান সরকার একেবারেই চায়নি কাজানের স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ইরানি নারীদের দেখা যাক। প্রকাশ্যে, স্টেডিয়ামে বসে ইরানি নারীরা যেন খেলা দেখতে না পারেন, সে চেষ্টাও চালিয়েছিল সরকার। খেলা শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে স্টেডিয়ামে প্রবেশের সব কটি দরজা বন্ধ করে রেখেছিল পুলিশ। ইরানি সমর্থকদের চাপে এবং সে সময় চলা বিতর্কে পুলিশের পরাজয়ের কারণেই মাঠে ঢুকতে পারলেন ইরানি সমর্থকেরা, যাঁদের মধ্যে ছিলেন নারী সমর্থকেরাও। ফুটবল-পাগল দর্শকের সামনে, কাজানের মাটিতে উড়ে গেল নিষেধাজ্ঞা।

খেলার পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে কাজানের রাস্তাগুলো ছিল ফাঁকা, বিশ্রাম নিচ্ছিলেন খেলা দেখে ক্লান্ত মানুষ। রাস্তায় পাহারায় ছিল পুলিশের প্যাট্রল কার। একটু একটু করে জেগে উঠছিল শহর। সমর্থকের দল আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠে এই শহরের শেষ সেলফিটা তুলে নিচ্ছিল। একটি ফাস্ট ফুড দোকানে সীমা নামের এক ইরানি নারীর সন্ধান পেলেন জার্মানির ডাই ওয়েল্ট পত্রিকার সাংবাদিক ইবরাহিম নাবের। সীমা আর তাঁর বন্ধু আমির সেখানে বসে কফি খাচ্ছিলেন। সীমার বয়স ৩৪। তাঁর ঠোঁট লিপস্টিকে রাঙানো, চোখে রোদচশমা, ঘাড়ে ঝুলছে ইরানের প্রতীক আঁকা রুমাল। সীমা সেই সৌভাগ্যবতীদের একজন, যাঁরা কাজানের আজাদি স্টেডিয়ামে খেলা দেখেছেন, ভেঙেছেন ৩৭ বছরের সরকারি নিষেধাজ্ঞা।

সীমা বলছিলেন ইবরাহিমকে, ‘স্টেডিয়ামে গিয়ে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আমি চিৎকার করেছি, আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠেছি!’ কয়েক সপ্তাহ ধরেই সীমা বিপুল উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, কবে স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখবেন। খেলা উপভোগ করার মাধ্যমে তাঁর তারুণ্যের স্বপ্ন মূর্ত হয়ে উঠল। সীমার ভাষায়, তিনি পাগলের মতো ইরান দলকে সমর্থন করেন না। কিন্তু সমর্থন করেন মনপ্রাণ দিয়েই। তিনি বললেন, ‘কী যে ভালো হতো, ইরানে যদি জাতীয় দলের খেলা দেখার জন্য নারীরা স্টেডিয়ামে ঢোকার অনুমতি পেতেন! আমরা তাহলে আমাদের দলের প্রতি আমাদের আগ্রহ ও সমর্থন দেখানোর সুযোগ পেতাম।’ এ থেকেই প্রশ্ন ওঠে, এই ঘটনার পর কি ইরান নারীদের স্টেডিয়ামে ঢোকার অনুমতি দেবে? সীমা অবশ্য মনে করেন না, এ রকম ঘটনা খুব কাছের কোনো সময়ে ঘটবে। তবে তিনি আশাবাদী হয়েই ইবরাহিমকে বলেন, ‘একদিন না একদিন আমি তেহরান স্টেডিয়ামে বসেই খেলা দেখব।’

অবশ্য সবাই সীমার মতো আশাবাদী নন। ফারজানাও খেলা দেখতে এসেছেন। তিনি মনে করেন, ইরানে খুব শিগগির এ ব্যাপারে ইতিবাচক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। একনায়কেরা সাধারণত ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন চান না।
ইবরাহিম বলছেন, ‘ফারজানা বসে আছেন পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত ফুটপাতের পাশে। তাঁর দীঘল কালো চুল এলিয়ে পড়েছে রাস্তায়। তাঁর জিনসের প্যান্টের পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে ইরানের ছোট্ট একটি পতাকা। তেহরানবাসী এই ফারজানাও স্পেনের সঙ্গে ইরানের খেলাটি দেখেছেন এবং বলা বাহুল্য, এটাই স্টেডিয়ামে বসে প্রথম খেলা দেখা।’ খেলা দেখে ফারজানা আবেগে ভেসে গেছেন। তিনি আগে শুধু ভেবেই এসেছেন কী বিশাল দক্ষযজ্ঞ এটা। ভেবে কূলকিনারা পাননি। মাঠে ঢুকে তিনি বুঝেছেন, ‘এ এক দানবীয় উৎসব, যার একটি ছোট অংশ হলো মাঠের ম্যাচটি।’

কাজানের আজাদি স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে নিজ দেশের খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিয়েছেন ইরানি নারীরা
কাজানের আজাদি স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে নিজ দেশের খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিয়েছেন ইরানি নারীরা

অন্য বেশে ফারজানাই ইবরাহিমকে জানিয়েছেন কিছু তথ্য, যার একটি হলো ফারজানার মেয়েবন্ধুদের অনেকে কয়েক বছর ধরেই তেহরানের স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখছেন, সমর্থন করছেন নিজ পছন্দের দলকে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কীভাবে সেটা সম্ভব? খুবই সহজ। এই নারীরা স্টেডিয়ামে ঢুকেছেন পুরুষের পোশাকে। রাশিয়া বিশ্বকাপেও এ ধরনের ইরানি নারীদের দেখা মিলবে, যাঁরা চুল ছেঁটে সমর্থন দিয়ে চলেছেন নিজ দলকে! ফারজানা মনে করেন, একটা সময় নিশ্চয়ই আসবে, যখন নারীদের পুরুষ সেজে স্টেডিয়ামে ঢুকতে হবে না। তবে বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, তাতে এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে।
তবে সীমা ও ফারজানার মতো অনেক ইরানি ফুটবলপ্রেমী নারী আশা করেন, ইরান সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা তো এই খেলা দেখেছেন, তাঁরা দেখেছেন খেলার আগে-পরে রোমাঞ্চকর সন্ধ্যা ও রাতে নারীরা টি-শার্ট গায়ে, ইরানি জাতীয় প্রতীকে নিজেকে জড়িয়ে হাসছেন, গাইছেন, সমর্থন করছেন প্রিয় দলটিকে। দেখেছেন, বুলেভার্ডজুড়ে সমর্থকদের মিছিলে পায়ে পা মিলিয়ে চলেছেন ইরানি নারীরা। এবার কিছু বদলাতেও পারে। আবার শঙ্কাও থাকে—নাকি এবার টেলিভিশন দেখে দেখে সাহসী ইরানি নারীদের শনাক্ত করা হবে?
প্রথম পর্বের শেষ খেলায় পর্তুগালের সঙ্গে সমানতালে লড়েছে ইরান। এবার গ্রুপ পর্ব থেকে দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু যে দৃষ্টিনন্দন ফুটবল প্রদর্শন করেছে দলটি, তাতে অনেকের মুখেই ইরান দলের প্রশংসা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ইরানি দলের খেলা ভালো হচ্ছে দিনে দিনে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, দলকে সমর্থন দিতে আসা সে দেশের নারী-পুরুষের সম্মিলিত পথচলা কি শেষ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল ডিঙাতে পারবে?
আশাবাদী হতে হয় এই কারণে—এটা ২০১৮ সাল। পৃথিবী সামনের দিকে চলেছে, পেছন দিকে নয়।

ডাই ওয়েল পত্রিকা অবলম্বনে