'এমন অভিনন্দন-প্রশংসার সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলাম না'

>জন্ম, বেড়ে ওঠা, সবই ডেনমার্কে। বছর পাঁচেক ধরে খেলছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। কাতারের বিপক্ষে গোল করে এশিয়াড ফুটবলে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় রাউন্ডে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশকে। এই অর্জনের মাহাত্ম্য নিয়ে কথা বললেন দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া।
বাংলাদেশের ফুটবলের স্মরণীয়তম জয়ের নায়ক। প্রথম আলো ফাইল ছবি
বাংলাদেশের ফুটবলের স্মরণীয়তম জয়ের নায়ক। প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রশ্ন: কাতারকে হারানোর পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তো দিয়েছেন। আনন্দটা কি আগের মতোই আছে? 
জামাল ভূঁইয়া: আমার তো মনে হয়, এখনো ঘোরের মধ্যে আছি। এমন অনুভূতি আসলে আগে কখনো হয়নি। পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের জার্সিতে খেলছি। কখনো এমন লাগেনি। আজকের দিনটা সত্যিই আলাদা। সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে, প্রশংসা করছে। এসবের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলাম না।

প্রশ্ন: ফুটবল দল শুধু হারছিল এত দিন। ফিফা র‍্যাঙ্কিং প্রায় ২০০ ছুঁইছুঁই। এমন সময়ে কাতারকে হারিয়ে এশিয়ান গেমসের মতো প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠাকে কীভাবে দেখছেন?
জামাল: এটা অনেক বড় অর্জন বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য। কাতার প্রায় এক শ ধাপ (৯৬) এগিয়ে আমাদের চেয়ে। মানুষ শুধু র‍্যাঙ্কিং দেখে। বাংলাদেশে সারা দিন শুধু এই এক আলোচনা। তবে কাল আমরা প্রমাণ করেছি, র‍্যাঙ্কিংয়ে অনেক এগিয়ে থাকা দলকেও আমরা হারাতে পারি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা জয় বলতে হবে এটিকে। কীভাবে এল এই জয়? 
জামাল: আমরা কোচের নির্দেশনা মেনে খেলেছি। যেটা দরকার, সেটা করেছি। আমাদের খাদ্যাভ্যাস এখন বদল হয়েছে। স্বাস্থ্যের জন্য ভালো জিনিসটাই আমরা এখন খাই। এভাবে আস্তে আস্তে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তবে আমাদের আরও কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। একটা বড় ম্যাচ জেতা মানে সব পেয়ে গেছি আমরা, তা নয়। আমাদের আরও ভালো করতে হবে।

প্রশ্ন: এই এশিয়াডের শুরু থেকেই বাংলাদেশ দলটাকে বেশ আত্মবিশ্বাসী লাগছিল। ‘আমরাও পারি’ এমন একটা মানসিকতা। আগে তো আপনাদের খেলায় এটা দেখা যায়নি...

জামাল: সময়ের সঙ্গে আমরা বুঝতে শিখেছি যে ভয় পেলে চলবে না। ভয় দূর করে আমরা থাইল্যান্ড ম্যাচে ভালো খেলেছি। উজবেকিস্তান ম্যাচটা আমাদের জন্য কঠিন ছিল। সেদিন আমরা মাঠে নেমে নার্ভাস হয়ে পড়ি। তবে সেটা আমরা কাটিয়ে উঠেছি দৃঢ় মানসিক শক্তি দিয়ে। তাই অনেক ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, কিছু একটা করেছি। দারুণ, দারুণ।

প্রশ্ন: ২০১৬ সালের অক্টোবরে ভুটানের সঙ্গে ওই হারের পর দেশের ফুটবলে তো ‘গেল’ ‘গেল’ রব উঠে গিয়েছিল। সেটিকে কি ঠিক মনে করেন? একটি ম্যাচে হার মানেই কি সব শেষ?
জামাল: ভুটান ম্যাচটার সময় আমি ডেনমার্কে ছিলাম। আমাকে কোচ সেন্টফিট বাদ দিয়েছিলেন দল থেকে। আমি নাকি তাঁর পরিকল্পনার সঙ্গে যাই না। কষ্ট পেলেও কোচের সিদ্ধান্ত মেনে নিই। তবে বাইরে থেকেও সব লক্ষ রাখতাম। বাংলাদেশ দল তখন সব ম্যাচ হারত। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তবে এখন সব ঠিক হয়ে গেছে।

প্রশ্ন: বাদ পড়া কি মনে বাড়তি একটা জেদ তৈরি করেছিল যে দলে ফিরে ভালো কিছু করতেই হবে?
জামাল: অবশ্যই। জেদ তো তৈরি হয়েছিলই। আমার অনেক খারাপ লেগেছে তখন। কোচ আমাকে বাদ দিয়ে এমন এমন খেলোয়াড় নিয়েছেন, যারা ক্লাবে নিয়মিত নয়।

প্রশ্ন: কাতারকে হারানোর পর ওই দলের কারও সঙ্গে কথা হয়েছে? যেহেতু একই হোটেলে আছেন...
জামাল: ম্যাচের পর কাতারের কয়েকজন কর্মকর্তা আমাকে বললেন, তাঁরা অবাক হয়েছেন আমাদের খেলা দেখে। আমাদের নাকি অনেক সহজ ভেবেছিল কাতার দলটা। কেন ভেবেছিল, তারাই জানে। এবার বিশ্বকাপে অনেক ছোট দল ভালো করেছে। কাজেই আমরা কেন এশিয়ান গেমসের নকআউটে উঠতে পারব না? আমি তখন তাদের এ কথাগুলো বলেছি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের ফুটবলে আপনার শুরু ২০১৩ সালে। শুরুর আর এখনকার সময়ে কী পার্থক্য দেখছেন?
জামাল: অনেক পার্থক্য। আগে সুযোগ-সুবিধা কম ছিল। এখন মোটামুটি যা চাওয়া যায়, সবই পাওয়া যায়। ফেডারেশন আমাদের দুবার কাতার এবং একবার দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুশীলন ক্যাম্প করিয়েছে। এটা অনেক বড় ব্যাপার। সব সময়ই দেখি, ফুটবল নিয়ে নেগেটিভ নিউজ। আজ সব পজিটিভ। এটাই তো বড় পার্থক্য।

প্রশ্ন: কাতার ম্যাচের বিরতির সময় কোচ জেমি ডের কথায় আপনারা উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। তিনি আসলে কী বলেছিলেন?
জামাল: বলেছেন, কাতারের টাকা থাকতে পারে, কিন্তু তোমাদের আছে সাহস। তোমরা মন দিয়ে খেললে ওরা পারবে না। আমরা ছেড়ে দেব না ভেবেই মাঠে নামি। কোচ আরও বলেছিলেন, সামনে বড় সুযোগ। খেলার প্রতি মনোযোগ রাখো। সুযোগ পেলে গোল কোরো।

প্রশ্ন: সেই জয়সূচক গোলটা আপনিই করলেন। জাতীয় দলের হয়ে আপনার একটিই গোল, সেটিও চার বছর আগে। কাতারের বিপক্ষে এমন মহামূল্যবান গোলটা করবেন বলে ভেবেছিলেন?
জামাল: ভাবিনি, এভাবে গোল করে দলকে স্মরণীয় এক প্রাপ্তি এনে দেব। যখন বাড়তি ৪ মিনিট যোগ করা হবে বলে দেখানো হলো, আমি একটা চান্স নিয়েছি। গোলকিপারের কাছ থেকে জনি বল পাওয়ার পর ওকে বললাম, জনি, বল দাও, বল দাও। ও বল দিয়েছে। মাঝমাঠের একটু সামনে থেকে ৪-৫টা টাচে সামনে গিয়ে দেখি গোলরক্ষক ঠিক জায়গায় নেই। তাই আস্তে গড়ানো শটটা নিই, গোল হয়ে যায়। এই গোল আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

প্রশ্ন: ২৪ আগস্ট এশিয়াডের দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচ। তো স্বপ্নের দ্বিতীয় রাউন্ড নিয়ে কী ভাবছেন?
জামাল: গত ম্যাচে যা ঘটেছে, সব ভুলে যেতে চাই। আজ নতুন একটা দিন। সবাইকে বলেছি, আনন্দ যা করার করেছ, এখন এগুলো বাদ দাও। পরের ম্যাচ নিয়ে ভাবো। (পরের ম্যাচের প্রতিপক্ষের) ভিডিও দেখে পরিকল্পনা ঠিক করব। চেষ্টা করব, অবশ্যই সম্মান নিয়ে মাঠ ছাড়তে।

প্রশ্ন: দেশে ফিরেই সাফ টুর্নামেন্ট। এখন সাফ জেতা কি সম্ভব মনে হচ্ছে?
জামাল: আমাদের পক্ষে সাফ জেতা সম্ভব। আমি মনে করি, আমাদের ভালো একটা দল আছে। এই দলটাকে নিয়ে সামনে এগোনো যায়। আমি এখন খুব আশাবাদী সাফের ব্যাপারে।