তামিমের মাঠে নামার নেপথ্যে...

এভাবেই গ্লাভস কেটে ব্যাটিংয়ে নেমে ছিলেন তামিম।
এভাবেই গ্লাভস কেটে ব্যাটিংয়ে নেমে ছিলেন তামিম।
কবজিতে চোট পেয়েছিলেন ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারে। ড্রেসিংরুমে ফিরে গেলেন, হাসপাতালেও যেতে হয়েছে। এ অবস্থায় তামিমের মাঠে ফেরার কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। কিন্তু সবাইকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে তামিম মাঠে ফিরে লিখেছেন বীরত্বের এক হিরণ্ময় ইতিহাস। কিন্তু এই ইতিহাসের জন্ম দেওয়ার পেছনে কী গল্প?


‘সবার উচিত তামিমকে মনে রাখা।’

কথাটা স্বয়ং মাশরাফি বিন মুর্তজার। কালকের ম্যাচ না দেখে থাকলে প্রশ্ন উঠতে পারে, তামিম এমনিতেই দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। তাঁকে আলাদা করে মনে রাখার কী আছে?

ম্যাচটা যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের জবাব হতে পারে—‘সুপার হিরোদের আলাদা করে মনে রাখতেই হয়।’ কিন্তু কাল রক্ত–মাংসের তামিমের হঠাৎ করেই ‘অতিমানব’ হয়ে ওঠার নেপথ্য সিদ্ধান্তটা কার? ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে নিশ্চিতভাবেই প্রশ্নটা আসছে।

তামিম কিন্তু আঙুলে চোট পেয়েছিলেন আগেই। ঝুঁকি আছে জেনেও তিনি এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচেই মাঠে নামতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু তাঁর বিধিলিপিতে কাল অন্য চিত্রনাট্য লেখা ছিল। তাই দ্বিতীয় ওভারেই চোট পেলেন কবজিতে। ফিরে যেতে হয় ড্রেসিংরুমে। সেখান থেকে হাসপাতালে। তাঁর কবজিতে চিড় ধরা পড়েছে। চিকিৎসক জানালেন, প্রায় ছয় সপ্তাহ মাঠের বাইরে থাকতে হবে। অর্থাৎ, তামিমের এশিয়া কাপ শেষ। কিন্তু কে জানত, তামিমের এশিয়া কাপ তখনো শেষ হয়নি। কে জানত, চিকিৎসক তাঁকে মাঠের বাইরে থাকার রায় দিয়ে দেওয়ার মাত্র দুই ঘণ্টা পরই সেই তামিমকে আবারও মাঠে দেখা যাবে!

বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য সে এক ব্যাখ্যাতীত সুখানুভূতির দৃশ্য। জল টলমল ঝাপসা চোখে তা দেখেছেন অনেকেই। মোস্তাফিজুর রহমান আউট হওয়ার পর ড্রেসিংরুম থেকে ব্যাট করতে বেরোচ্ছেন তামিম! বাঁ হাতের দুই আঙুলে ব্যান্ডেজ থাকায় গ্লাভসটা বিশেষভাবে কেটে পরেছিলেন। এরপর এক হাতেই ব্যাট ধরে লাকমলের সেই ওভারের শেষ বলটা যখন ঠেকালেন, নৈতিক জয় তো তখনই নিশ্চিত!

তামিমের এই সাহস, দেশের জন্য নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার মানসিকতা এখন ক্রিকেট ইতিহাসের রূপকথাগুলোরই অংশ। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এমন ঘটনা নজিরবিহীন। কিন্তু তার পেছনের গল্পটা কী?

জানা গেছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে তামিমকে ব্যাট করতে পাঠানোর সিদ্ধান্তটা দলেরই ছিল। তবে এই সিদ্ধান্তে অধিনায়ক মাশরাফির অনুপ্রেরণা ছিল সবচেয়ে বেশি। অষ্টম উইকেট পড়ার পর সিদ্ধান্ত হয় আরেক উইকেট পড়লে এবং মুশফিক যদি স্ট্রাইকে থাকেন, তাহলে তামিম মাঠে ফিরবেন। সহজ হিসাব—মুশফিক স্ট্রাইকে থাকলে তামিমকে চোটগ্রস্ত আঙুল নিয়ে ব্যাট করার ঝুঁকি নিতে হবে না। তামিম নন-স্ট্রাইকে থেকে মুশফিককে সঙ্গ দেবেন আর মুশফিক একা ব্যাটিং করে বাকি কাজটুকু সারবেন।

কিন্তু সহজ হিসাবটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ৪৭তম ওভারের পঞ্চম বলে নবম উইকেট (মোস্তাফিজ) পড়লে। মুশফিক তখন নন–স্ট্রাইকে। আর ওভারের এক বল বাকি। অধিনায়ক মাশরাফির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তখন আর মাঠে নামার কথা নয় তামিমের। আর ২২৯ রানেই গুটিয়ে যাওয়ার কথা বাংলাদেশের।

মাশরাফি কিন্তু তার আগেই তামিমের মাঠে নামার জোগাড়যন্ত্র সেরে রেখেছিলেন। দুটি আঙুলে ব্যান্ডেজ থাকায় তামিমের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে গ্লাভস পরা সম্ভব হতো না। মাশরাফি তাই নিজেই তামিমের বাঁ হাতের গ্লাভসের তালুর অংশ কেটে বিশেষভাবে প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ওভারে মুশফিক নন–স্ট্রাইকে থাকায় মাঠে ফেরার সিদ্ধান্তটা তামিমের একার কাঁধে চলে আসে। মানে, তামিমকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি মাঠে ফিরবেন কি না। এই পরিস্থিতিতে তামিমকে চেনেন এমন যে–কেউই বুঝতে পারবেন সিদ্ধান্তটা কার।

বাঘা বাঘা পেসারের নিখুঁত লেংথের ডেলিভারি কিংবা ভয়াল গতির বাউন্সারকে সীমানাছাড়া করতে তামিমের কখনো বুক কাঁপেনি। তাহলে সামান্য দুটি আঙুলের ভাবনায় দেশের জন্য নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার এই সুযোগ তিনি হারান কীভাবে! বুক চিতিয়ে লড়াই করাটা তামিমের মজ্জাগত। আর তাই সেই মুহূর্তে মাঠে নামার সিদ্ধান্তটা তামিমের একার। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘মোস্তাফিজ ওই ওভারের পঞ্চম বলে আউট হওয়ায় মুশফিক নন–স্ট্রাইকে ছিল। সিদ্ধান্তটা তাই আমাকে নিতে হয় এবং আমি একটা বলের মুখোমুখি হয়ে মুশফিককে স্ট্রাইকে পাঠাতে চেয়েছি।’

সতীর্থদের তামিম তখন বলেছেন, আমি গিয়ে এক বল খেলব। আমি যাব। ব্যস, বাকিটা ইতিহাস। মাশরাফি সেই ইতিহাস গড়ার মন্ত্রণাদাতা, তামিম কারিগর। শুনুন তামিমের মুখেই, ‘মাশরাফি ভাই (মাঠে ফেরার) আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছেন। সারাক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ব্যান্ডেজ করা আঙুলের জন্য গ্লাভসও কেটে দিয়েছেন। কিন্তু মুশফিক তখন নন–স্ট্রাইকে থাকায় সিদ্ধান্তটা আমাকে নিতে হয়েছে।’

চোট, ব্যান্ডেজ নিয়ে তামিমের মাঠে ফেরার সেই সিদ্ধান্তের জন্যই মাশরাফি বলেছেন, লোকের উচিত তামিমকে মনে রাখা।

তামিমের এক হাতে ব্যাটিংয়ের ভিডিও লিংক:

আরও পড়ুন...