'১০ লাখ টাকা তো আমি আগে কোনো দিন দেখিনি'

গতকাল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সামনে আঁখি খাতুন ও তাঁর বাবা। ছবিঃ প্রথম আলো
গতকাল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সামনে আঁখি খাতুন ও তাঁর বাবা। ছবিঃ প্রথম আলো
>মেয়েকে দেখার জন্য গতকাল ঢাকা এসেছিলেন আঁখি খাতুনের বাবা আক্তার হোসেন। বাবার হাতেই তুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া ১০ লাখ টাকার চেক।

‘আব্বু, তুমি আমার চোখ নিয়ে চিন্তা কইরো না তো’—বাবাকে অভয় দেন আঁখি খাতুন। বাবা হয়েও মেয়ের সামনে বাধ্য ছেলের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতিসূচক জবাব দেন আক্তার হোসেন। কিন্তু বাবার দুশ্চিন্তা কি আর কমে! ভুটানে অনূর্ধ্ব ১৮ সাফের ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে শিরোপা জয়ের ম্যাচে চোখে আঘাত পেয়েছিলেন আঁখি। এখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। চোখটা এখনো টকটকে লাল। এই লাল আক্তারের বুকে ভয় ধরিয়ে দেয়।

মেয়েকে দেখার জন্য গতকাল ভোরে সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকা এসেছেন আক্তার। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে মেয়ের সঙ্গে দেখা হলো দুপুরে। অনুশীলন শেষে কামরায় যাওয়ার পথে বাবার সঙ্গে আঁখি গল্প জুড়ে দেন বাফুফে ভবনের মাঠে। একমাত্র মেয়ের আঘাত পাওয়া চোখে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেন বাবা। কিছুটা শাসনের সূরেই আক্তারের অনুযোগ, ‘একটু সাবধানে কি খেলান যাই না মা।’

মাঠে নামলে কি আর শরীর বাঁচিয়ে খেলা যায়! আর আঁখি তো বাংলাদেশ রক্ষণের অন্যতম প্রহরী। প্রতিপক্ষের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে সে ঝুঁকি নিতে পরোয়া করে না। তাঁর কাছে পরীক্ষা দিয়েই বাংলাদেশের গোলপোস্টের সামনে যেতে হয় প্রতিপক্ষ স্ট্রাইকারদের। দীর্ঘদেহী এই সেন্টারব্যাকের সঙ্গে প্রতিপক্ষ পেরে ওঠেনি বলেই সাফের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন আঁখি। শুধু কি সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ? গত বছর সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টেও সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের এই মেয়ে।

৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার ডিফেন্ডার আঁখিকে বেশ দূর থেকেও চেনা যায়। শারীরিকভাবে বেশ শক্তিশালী। রক্ষণভাগে খেললেও নিচ থেকে বাতাসে ভাসানো পাসে গোল করাতেও পটু। অনূর্ধ্ব ১৮ সাফের আগে গত মাসে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তাঁর বড় অবদান। এই পারফরম্যান্সের পুরস্কার স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেক খেলোয়াড়ের হাতে তুলে দিয়েছে ১০ লাখ টাকার চেক।

আঁখি গতকাল সেই চেক তুলে দিয়েছেন বাবার হাতে। আঁখির বাবা আক্তার এর আগে ১০ লাখ টাকা নাকি কখনোই দেখেননি, ‘নিজে রুজি করা তো দূরের কথা, ১০ লাখ টাকা বা চেক তো আমি আগে কখনো দেখিই নি। মেয়ের জন্য তা দেখার সৌভাগ্য হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। এই টাকাটা আমাদের জন্য বিশাল কিছু। টাকা দিয়ে কিছু জমি কিনব। মেয়ের নামে ব্যাংকে রাখারও ইচ্ছে আছে।’

একটি তাঁত শ্রমিক পরিবারের জন্য ১০ লাখ টাকা সত্যিই বিশাল কিছু।

এক সময় তাঁতের খটাখট শব্দে প্রতিদিন ঘুম ভাঙত আঁখির। শাহজাদপুরের পাটগোলা গ্রামের তাঁতিপাড়ায় গেলে কাপড় বোনা মাকুর শব্দ এখনো কানে বাজবে। সেই গ্রামের আর দশটা মেয়ের মতো মায়ের সঙ্গে সুতো বুনে দিন পার করত আঁখি। তাঁর বাবা তাঁতশ্রমিক। তাঁদের নিজেদের কোনো তাঁতের মেশিন নেই। অন্যের মেশিনে তাঁত বুনে সংসার চলে আঁখিদের। মা নাসিমা বেগমের চাওয়া ছিল মেয়ে যেন সংসারের কাজে তাঁকে সাহায্য করে। আর বাবাও মেয়েকে তাঁর সঙ্গে কাজে লাগাতেন। সুতো বোনা থেকে লড়ি চালানো সবই নাকি ছিল আঁখির মুখস্থ, ‘স্কুল থেকে এসেই আঁখি আমাদের সঙ্গে কাজে হাত দিত। লরি আগাইয়া দিত মেয়েটি...’—আঁখির বাবার স্মৃতিচারণ।

আঁখির হাতের কারুকাজে রঙিন কাপড়ে হয়তো ফুটে উঠত বাহারি নকশা। এখন আর তা না হলেও আঁখি কিন্তু আলপনা আঁকছে। পায়ের কারিকুরিতে সবুজ ক্যানভাসে সে রচনা করছে উঠে আসার আলপনা।