কিউরিয়াস কেস অব মুমিনুল হক

আবারও ব্যর্থ হলেন মুমিনুল। ছবি: শামসুল হক
আবারও ব্যর্থ হলেন মুমিনুল। ছবি: শামসুল হক
>৮৩.৪২, ৭১.৩৩, ৭৫.৫০...এগুলো কী? মুমিনুল হকের ব্যাটিং গড়। ২৭.৮৫? এটাও মুমিনুলের গড়। একসময় ব্যাটিং গড়ের কারণে মুমিনুল আর ব্র্যাডম্যান একই শিরোনামের ব্র্যাকেটবন্দী হয়েছিলেন। সেই তিনি নিজের ব্যাটিং গড় ক্রমেই নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন

পশ্চিমের গ্যালারিটা বড় অদ্ভুত। পাহাড়ের ঢালে খাঁজ কেটে বানানো গ্যালারি। পাহাড়ে বসে গা এলিয়ে দিয়ে খেলা দেখার বন্দোবস্ত। সেই গ্যালারিকে প্রেক্ষাপটে রেখে মাথা নিচু করে যখন হেঁটে যাচ্ছিলেন মুমিনুল হক, দৃশ্যটাকে বড় প্রতীকী লাগছিল। পাহাড়ের এই ধাপে ধাপে নেমে আসা সিঁড়ি মতন দেখতে গ্যালারিটাই যেন মুমিনুল। তাঁর এভারেস্টছোঁয়া ব্যাটিং গড় যে কেবলই ধাপে ধাপে নামছে। 

সিলেটে ৩০ নম্বর টেস্টটা খেলে ফেললেন এই বাঁহাতি। ভগ্নাংশের জটিলতায় না গিয়ে সহজেই দুই ভাগে ভাগ করা যায় তাঁর ক্যারিয়ার। প্রথম ১৫ টেস্টে শেষেও মুমিনুলের ব্যাটিং গড় ছিল ৫৫.২০। ১৪১০ রান করেছিলেন, চারটি সেঞ্চুরি, দুটি ফিফটি। পরের ১৫ টেস্টে এর অর্ধেক রান করলেন মুমিনুল। এক টেস্টে জোড়া সেঞ্চুরির পরও ২৭.৮৫ গড়ে ৭৮০ রান করেছেন। দ্বিতীয়ার্ধের এই পতন তাঁর একসময়ের ৮৩.৪২ ব্যাটিং গড়টাকে এখন টেনে নামিয়ে এনেছে ৪২.১১-এ।

টেস্টে ৩০ ম্যাচ শেষে কোনো ব্যাটসম্যানের গড় ৪২-এর ওপরে, অবশ্যই মন্দ নয়। কিন্তু উত্থান আর পতনের বিপরীতমুখী চিত্র মুমিনুলকে নিয়ে ভাবতে প্রশ্ন করছে। প্রতিভা আর সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন নেই বলেই উদ্বেগটা আরও বেশি। টানা দুই বছর আর ২৩ ইনিংসে (২০১৫-২০১৭) কোনো সেঞ্চুরি না-পাওয়ার নেতিবাচক বিস্ময়টা এ বছরের প্রথম টেস্টে জোড়া সেঞ্চুরি মুছে দিয়েছিলেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গিয়েছিল।


টেস্ট ইতিহাসে মাত্র ৬৭তম ব্যাটসম্যান হিসেবে ম্যাচে জোড়া সেঞ্চুরি। চট্টগ্রামের যে কীর্তি দিয়ে এমন সব ব্যাটসম্যানদের তালিকায় নাম লিখেছেন, যাঁরা প্রত্যেকে নিজেরাই একেকটা ইতিহাস। ব্র্যাডম্যান, চ্যাপেল, বোর্ডার, গাভাস্কার, দ্রাবিড়, অরবিন্দ ডি সিলভা, কম্পটন, গুচ, গ্রিনিজ, হেডলি, লারা, হানিফ মোহাম্মদ, মিয়াঁদাদ, পন্টিং, সাঙ্গাকারা, সাটক্লিফ, লরেন্স রো, সোবার্স, ওয়ালকট, এভারটন উইকস, কানহাই, হেইডেন, হ্যামন্ড, জ্যাক ক্যালিস, আর্থার মরিস; বর্তমান সময়ের দুই সেরাতম প্রতিভা বিরাট কোহলি আর হাশিম আমলা।

কিন্তু এরপর আবার পথ হারানো শুরু। সেই জোড়া সেঞ্চুরির পরের আট ইনিংসে করেছেন ৬৯ রান! সর্বশেষ আট ইনিংসে তাঁর ব্যাটিং গড় বের করতে ৬৯–কে ৮ দিয়ে ভাগ করতে ইচ্ছেই করছে না। যেমন সত্যি জেনেও বিশ্বাস করতে মন চাইছে না, এর মধ্যে পাঁচ ইনিংসের তিনটাতে শূন্য মেরেছেন! ক্যারিয়ারেই যার মাত্র ৬টি শূন্য।

সমস্যা যদি কোথাও হয়ে থাকে, সেটি তাঁর আত্মবিশ্বাসে। আজ কাইল জার্ভিসের যে বলে আউট হয়েছেন, না সে বল নয়, তার আগের বলটাই সম্ভবত খুব ভালো করে বোঝাবে মুমিনুলকে। আগের ওভারে সিকান্দার রাজাকে ডাউন দ্য উইকেটে নেমে এসে মারাটা যদি আত্মবিশ্বাসের ব্যালেন্সে ক্রেডিট হয়, জার্ভিসের কিছুটা শর্ট লেংথে পড়ে অস্বস্তি উচ্চতার বাউন্স নিয়ে মুমিনুলের ব্যাট একটুর জন্য না-ছুঁয়ে বেরিয়ে যাওয়া বলটা প্রবলভাবে ধাক্কা দিল সেই ব্যালেন্সের ডেবিটে। ফলাফল? পরের বলটাতেই প্লেইড অন। ডিফেন্সিভ শট খেলেও ঠিক সময়ে শরীরটাকে উইকেটকে আগলে রাখার সময়ই পেলেন না।

মুমিনুলের আত্মবিশ্বাস নড়ে গেছে প্রবলভাবে। তাতে তাঁর দায় কতটা, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। হঠাৎ হঠাৎ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পান, বাকি সময়টা কাটে ঘরোয়া ক্রিকেটে। নিয়মিত আন্তর্জাতিক আবহের ছোঁয়াচ না পেলে, বছরে সাতটা কি আটটা করে ম্যাচ খেললে ছন্দ ধরে রাখা বিরাট কোহলির পক্ষেও হয়তো সম্ভব হতো না। মুমিনুল নিজেও যেন দ্বিধান্বিত, কোন পথে যাবেন? 

যখন কেউ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, সে দায় তাঁর একার নয়। যেমন একার নয় হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার দায়িত্বটাও। মুমিনুলের মতো একটা সম্পদকে হারিয়ে ফেলার সামান্যতম ঝুঁকিও বাংলাদেশ নিতে পারে না!