প্রথমবারের মতো ইনিংস ব্যবধানে জয় বাংলাদেশের

প্রথমবারের মতো টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে জয় তুলে নিল বাংলাদেশ। ছবি: শামসুল হক
প্রথমবারের মতো টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে জয় তুলে নিল বাংলাদেশ। ছবি: শামসুল হক
>

মিরপুর টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ইনিংস ও ১৮৪ রানে হারিয়ে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। এই প্রথম ইনিংস ব্যবধানে কোনো টেস্ট জিতল বাংলাদেশ

টেস্ট ময়দানে প্রথমবারের মতো কোনো পেসার ছাড়াই মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের স্পিনবান্ধব উইকেটে পৌনে তিন দিনের ব্যবধানে ফলটাও মিলল হাতেনাতে—প্রথমবারের মতো ইনিংস ব্যবধানে জয়!

হারল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশ কি ‘প্রতিশোধ’ নিল? কথাটা সরাসরি বলা যাচ্ছে, আবার যাচ্ছে না। গত জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে পর্যুদস্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। এই সিরিজ শুরুর আগে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বলেছিলেন চার মাস আগের সেই সিরিজটা মনে রাখতে। সাকিবের সতীর্থরা সেই সিরিজ হারের জ্বালা কতটা পুষে রেখেছিলেন, তা বোঝা গেল মিরপুর টেস্টে। চট্টগ্রামে সিরিজের প্রথম টেস্টে ৬৪ রানের জয়টা যদি হয় শোধ নেওয়ার শুরু, মিরপুরে এক ইনিংস ও ১৮৪ রানের জয়টা তাহলে এর মধুর সমাপ্তি। কিন্তু তারপরও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২-০ ব্যবধানে ধবলধোলাই করা এই সিরিজ জয়কে প্রতিশোধ হয়তো বলা যায় না। ক্রিকেটীয় ভাষায় কথাটা ঠিক শোভন নয়।

কিন্তু জয়ের পর যে কথাটা শোভন লাগবে, পেসার ছাড়াও মাঠে নেমে এভাবে জয় তুলে নেওয়া যায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যদি তাদের ঘরের মাঠে নিজেদের শক্তি বিবেচনায় পেসবান্ধব উইকেট বানিয়ে ‘চিন মিউজিক’ শোনাতে পারে, বাংলাদেশ তাহলে নিজেদের শক্তি অনুযায়ী হেলিকপ্টারের ‘রোটর ব্লেড’-এর মতো বলের ঘূর্ণন শোনালে দোষ কোথায়? ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো এই ঘূর্ণি ফাঁদেই হাঁসফাঁস করে ফেঁসে গেল।

যেনতেন ফাঁস নয়, রীতিমতো মরণফাঁস। চট্টগ্রামে দলে পেসার রেখেও ক্যারিবীয়দের ২০টি উইকেট নিয়েছিলেন স্পিনাররা। মিরপুরে যে শুধু স্পিনাররাই উইকেট পাবেন, তা তো জানাই ছিল। পার্থক্য শুধু দাপটে। মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরি, সাদমান ও সাকিবের সেঞ্চুরির সুবাস পাওয়া দুটি ইনিংসে ভর করে ৫০৮ রানের পাহাড় গড়েছিল বাংলাদেশ। স্পিনের জাল বিছানো এই পাহাড়ে চড়তে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংস টিকেছে মাত্র ৩৬.৪ ওভার। স্কোরবোর্ডে রান উঠেছে ১১১—টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে যেকোনো দলের সর্বনিম্ন ইনিংস। শুধু কি তা–ই? ক্রেগ ব্রাফেটের দলকে পাঠানো গেছে ফলোঅনেও। সেটি আবার বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো।

আজ তৃতীয় দিন সকালের সেশনেই পড়েছে ৯ উইকেট। এর মধ্যে ৫ উইকেট প্রথম ইনিংসের, বাকি ৪টি দ্বিতীয় ইনিংসে। তখনই বোঝা গিয়েছিল লাঞ্চ বিরতিতে তৃপ্তির ঢেকুর তুলবেন সাকিব-মিরাজরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ লাঞ্চ করতে পেরেছে কি? ডেনজা হেটমায়ার হয়তো ভালোমতোই পেরেছিলেন। ৯ ছক্কা আর ১ চারে ৯২ বলে ৯৩ রান তুলে ভালোই জেদ মিটিয়েছেন মনের। তাতে অবশ্য দলের শেষ রক্ষা হয়নি। বাংলাদেশের ‘স্পিন চতুষ্টয়’-এর ঘূর্ণিতে দ্বিতীয় ইনিংসে ২১৩ রানেই অলআউট ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম ইনিংসের সঙ্গে পার্থক্য শুধু সময়ে—এই ইনিংসে ৫৯.২ ওভার ব্যাটিং করেছে তারা। কিন্তু স্পিনের বিপক্ষে ক্যারিবীয়দের কোনো ইনিংসেই স্বচ্ছন্দ ছিল না। হেটমায়ার তো চাপ কাটাতে মারতে মারতে আউট হলেন!

২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদেরই মাঠে ধবলধোলাই করেছিল বাংলাদেশ। তখন নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা চোট পেলে সাকিবের নেতৃত্বে সিরিজ জয়ের স্বাদ পেয়েছিল দল। ৯ বছর পর সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবারও ধবলধোলাই, এবার ঘরের মাঠে সেই সাকিবের নেতৃত্বেই। এই সিরিজে ট্যাকটিসের ক্ষেত্রে সাকিবের ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক যেন কমিকের ‘চাচা চৌধুরী’র মতো—কম্পিউটারের চেয়েও প্রখর!

সিরিজ শুরুর আগে দলকে উদ্দীপ্ত করেছেন চার মাস আগের সেই হারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে। মাঠে নেমে স্পিনারদের ব্যবহার করছেন দারুণ মুনশিয়ানার সঙ্গে। সাকিব নিজেও ছিলেন ঘূর্ণি-ছন্দে। ক্যারিবীয় ওপেনার ব্রাফেটকে তো দুইবারই আউট করেছেন ইনিংসের প্রথম ওভারে। আর মিরাজ? ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেট নেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট। টেস্টে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এক ম্যাচে ন্যূনতম ১০ উইকেট নিলেন মিরাজ। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, এই ম্যাচে ১১২ রান খরচায় ১২ উইকেট নিয়ে টেস্টে কোনো বাংলাদেশির সেরা বোলিং ফিগারটা নতুন করেও লিখিয়েছেন মিরাজ। আগের রেকর্ডটা তাঁরই ছিল। সেই যে ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ১৫৯ রানে ১২ উইকেট।

বাংলাদেশের জয়ের এই সিরিজ হয়ে থাকল স্পিনারদের। চট্টগ্রামে মোট ৪০ উইকেটের মধ্যে ৩৪ উইকেট নিয়েছিলেন দুই দলের স্পিনাররা। এর মধ্যে ২০ উইকেট ছিল বাংলাদেশের স্পিনারদের। মিরপুরে স্পিনারদের উইকেটসংখ্যা ২৭। এর মধ্যে ২০টি উইকেট যে বাংলাদেশের ‘স্পিন চতুষ্টয়’ ভাগ করেছেন তা আর বলতে! আসলে এই সিরিজ তো স্পিনারদের।