জাতীয় দলে কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা ঠিক না

অসাধারণ এক বছর গেল মুমিনুলের। ছবি: প্রথম আলো
অসাধারণ এক বছর গেল মুমিনুলের। ছবি: প্রথম আলো
>এ বছর আর টেস্ট নেই বাংলাদেশের। ‘টেস্ট ব্যাটসম্যান’ তকমা লেগে যাওয়া মুমিনুল হকেরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর ব্যস্ততা নেই। কদিন পর তিনি ব্যস্ত হয়ে যাবেন বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ (বিসিএল) নিয়ে। বিসিএল খেলবেন বলে কাল বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুম থেকে নিয়ে গেলেন খেলার সরঞ্জামাদি। যাওয়ার আগে প্রথম আলোকে বছরটা পর্যালোচনা করলেন এ বছর টেস্টে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান মুমিনুল

৮ টেস্টে ৪ সেঞ্চুরিতে ৪৪.৮৬ গড়ে ৬৭৩ রান করে এ বছর বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবার ওপরে মুমিনুল হক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে সেঞ্চুরি করে রেকর্ডের একটি অধ্যায়ে তামিম ইকবালকে ছুঁয়েছেন। টেস্ট সেঞ্চুরি সংখ্যায় তিনি এবং তামিম এখন পাশাপাশি। দুজনই করেছেন সর্বোচ্চ ৮ সেঞ্চুরি। কাল বিসিবি একাডেমি মাঠে মুমিনুল ফিরে দেখলেন পুরো বছরটা—

* বছরটা কেমন কাটল মুমিনুলের?
মুমিনুল হক: সবকিছু মিলিয়ে খারাপ কাটেনি। ভালো ছিল। দু-একটি টেস্টে রান করতে পারিনি। রান করতে পারলে হয়তো আরও ভালো হতো। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের বিচারে বলব বছরটা খারাপ যায়নি। তবে একটু তো আক্ষেপ থাকেই। আরও কিছু রান করতে পারলে আরও ভালো লাগত। তবে যেহেতু ৪টা সেঞ্চুরি করেছি, এ বছরকে ক্যারিয়ারের সেরা বছর বলা যায়।

* সেই আক্ষেপটা কেমন?
মুমিনুল: খুব একটা আক্ষেপ অবশ্য নয়। মাঝে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে রান না পাওয়ায় আরও বেশি সিরিয়াস ছিলাম। টেকনিক-ট্যাকটিক আরও কীভাবে উন্নতি করা যায়। আমার কাছে মনে হয় সব দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।

* ৪টি সেঞ্চুরি করেছেন এ বছর। কোনটি বেশি এগিয়ে রাখবেন?
মুমিনুল: একজন ব্যাটসম্যানের কাছে প্রতিটি সেঞ্চুরিই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে যেটি সিরিজ বাঁচানোর সেঞ্চুরি ছিল (জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে ১৬১), ওটা অনেক ভালো ছিল। কন্ডিশনও কঠিন ছিল। আর (ফেব্রুয়ারিতে) চট্টগ্রাম টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরিটা। প্রথমত, ১৭৬ রান। আর টেস্টটা আমরা পিছিয়ে থেকেও ড্র করি শেষ পর্যন্ত। ওই টেস্টের দুটি সেঞ্চুরিই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

* অবধারিত প্রশ্ন, চন্ডিকা হাথুরুসিংহের বিপক্ষে খেলেছেন বলেই কি চট্টগ্রাম টেস্টের সেঞ্চুরি দুটি আপনার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ?
মুমিনুল: ঘুরেফিরে এই প্রশ্নটা করা হয়। কোনো ম্যাচ যদি হারের শঙ্কা থাকে এবং সেখান থেকে ম্যাচটা বাঁচিয়ে ফেলতে পারেন, নিজের কাছে সেটি অনেক তৃপ্তির আর আনন্দের। মনে হয় দলের জন্য কিছু করতে পেরেছি। ব্যক্তিগতভাবেও ওই সময় কিছুটা চাপের মধ্যে যেতে হয়েছে। ওই টেস্টের আগে বাজে সময় গেছে। এটাও মাথায় ছিল।

* দুর্দান্ত ছন্দে ছিলেন। শেষটাও যদি রানে শেষ হতো, বছরের শেষ টেস্ট নিয়ে একটু অতৃপ্তি কি থেকে গেছে?
মুমিনুল: তেমন অতৃপ্তি নেই। তবে একটু রানক্ষুধা তো থেকেই যায়। শেষ টেস্টে রান করতে পারিনি। দল জিতেছে বলে এটা নিয়ে ভাবছি না। তবে ফল আমাদের পক্ষে না হলে তখন হয়তো খারাপ লাগত, মনে হতো আরও যদি ভালো খেলতাম...। ম্যাচটা আমরা জিতেছি। সেটি ভেবে অনেক খুশি। কোনো আফসোসও নেই। চিন্তা করি দিন শেষে দলের জন্য কতটা করতে পারলাম। যদি শূন্য রানে আউট হই এবং দল জেতে, মন খারাপ থাকে না। কিন্তু আমি কিছু করতে পারিনি, দলও হেরেছে, তখন অনেক খারাপ লাগে।

* ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে তো কিছু অর্জন ছিল আপনার। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সেঞ্চুরি সংখ্যায় তামিম ও আপনি এখন যৌথভাবে শীর্ষে (৮টি)। যেদিন তাঁকে স্পর্শ করলেন, তামিম কি আপনাকে কিছু বলেছিলেন?
মুমিনুল: না, তেমন কিছু বলেননি। তবে শুভকামনা জানিয়েছেন। এই সিরিজের আগেও বলছিলেন, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে টেস্টে সবার আগে আমার অনেক রান, সেঞ্চুরি হয়ে যাবে! তাঁর মতো একজন বড় খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এমন কথা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিলেট টেস্টের কথাই বলি, প্রথম ইনিংসে একটু রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলার চেষ্টা করি। সিকান্দার রাজার বলে আউট হই। ওই দিন রুমে আসার পর তামিম ভাই আমাকে বললেন, ‘স্পিন সাধারণত যেভাবে খেলিস, সেভাবে খেল। যদি বেশি রক্ষণাত্মক হয়ে যাস, সমস্যা হবে। ওদের স্পিনার তো এত উঁচু মানের নয়। বেশি মারতে হবে এমন নয়, তবে ঘাবড়ে যাওয়ারও কিছু নেই।’ ওইটা মাথায় ছিল। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে সেভাবেই খেলেছি। এমনকি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টেও ভালো খেলেছি। তামিম ভাই সব সময়ই আমাকে অনুপ্রাণিত করেন, তিনি সব সময়ই চান টেস্টে যেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান করি।

* নিউজিল্যান্ড সফরে দেখা গেল তামিম এবং আপনি একই সঙ্গে সেঞ্চুরির দিকে এগোচ্ছেন। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কতটা মজার হবে?
মুমিনুল: জাতীয় দলে কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা ঠিক না। এটা হলে হয় কী, অনেক সময় পরশ্রীকাতরতা এসে যেতে পারে। আর এসব নেতিবাচক ভাবনা নিজের খেলাটা ক্ষতি করে। মুশফিক ভাই যেদিন ডাবল সেঞ্চুরি করলেন (জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে), আমি তো সে ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি ফেলে এলাম। তবে মনেপ্রাণে চেয়েছি তিনি ডাবল করুন। তিনি প্রথম দিন থেকে যেভাবে ব্যাটিং করেছেন, ভেতর থেকেই আসছিল, মুশফিক ভাই যেন ২০০ করেন। সব সময়ই এটাই চাই। দলের সবাই বড় বড় কীর্তি গড়ুক।

* প্রশ্নটার উত্তর আগেও কিছুটা দিয়েছেন। এখন একটু বিস্তারিত জানতে চাই, চন্ডিকা হাথুরুসিংহে আসার আগে তিনটা টেস্ট সেঞ্চুরি, চলে যাওয়ার পর চারটি। তিনি চলে যাওয়ার পর টেকনিকে কী এমন পরিবর্তন এনেছেন যে ধারাবাহিক লম্বা ইনিংস খেলছেন?
মুমিনুল: মানসিকভাবে কিছুটা বদল আনার চেষ্টা করেছি। যত দিন ক্রিকেট খেলব, মানসিকভাবে বদল আনারই চেষ্টা করব। ক্রিকেট খেলাটা অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক। স্কিল তো আছেই। তবে মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জ নিতে হয় আগে। চাপ কীভাবে উপভোগ করা যায়, এসব নিয়েই কাজ করেছি। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এটাকে আমি ইতিবাচকভাবে নিয়েছি (হাথুরুর সময়ে রান না পাওয়া)। এটা নিয়ে আরও বেশি কাজ করার প্রেরণা বা আরও পরিশ্রম করার তাড়না অনুভব করেছি। যে পরিস্থিতিতে পড়েছি সেটির জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না গেলে কঠিন পরিশ্রমের তাড়না হয়তো সেভাবে অনুভব করতাম না। রানের ক্ষুধা তীব্র হতো না।

* আপনার আট সেঞ্চুরির প্রতিটিই দেশে। বিদেশে পরিসংখ্যান খুব একটা উজ্জ্বল নয়। দলের নিশ্চয়ই প্রত্যাশা, আপনি বিদেশের মাঠেও সমান উজ্জ্বল থাকবেন।
মুমিনুল: আমার নিজেরও প্রত্যাশা বিদেশে ভালো করব। শুধু দেশে ভালো করব, এটা কোনো খেলোয়াড়ই চায় না। দেশ-বিদেশে সব জায়গাতেই ভালো করতে চাই। তবে এটাকে চাপ হিসেবে নিচ্ছি না যে, আমাকে কিছু একটা করতেই হবে। এভাবে দেখলে ঘাবড়ে বা চাপের মধ্যে পড়ে যেতে হবে। চেষ্টা করব এই চ্যালেঞ্জটা উপভোগ করে উতরে যেতে।

* এ বছর আর টেস্ট নেই বাংলাদেশের। মুমিনুলকে আবারও চলে যেতে হচ্ছে জাতীয় দলের বাইরে। ব্যস্ত হতে হচ্ছে ঘরোয়া ক্রিকেটে। দারুণ ছন্দে থাকার পরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ নেই। সময়টা কীভাবে কাটে আপনার? কতটা উপভোগ করেন?
মুমিনুল: যখন খেলা থাকে না, চেষ্টা করি নিজের ঘাটতিগুলো নিয়ে কাজ করতে। সামনে যে সিরিজ থাকে সেটির প্রস্তুতি নিতে থাকি। এখন যেমন বিসিএলে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। বিসিএলে চেষ্টা করব নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রস্তুতি নিতে। জানি না কতটুকু হয়। তবে চেষ্টা করি।

আরও  পড়ুন :-