পাঁচ বছরে ২০টি সোনা!

ট্র্যাক শুষে নেয় শরীরের সব শক্তি। দৌড় শেষে ট্র্যাকেই শুয়ে পড়লেন সুমি। ছবি: প্রথম আলো
ট্র্যাক শুষে নেয় শরীরের সব শক্তি। দৌড় শেষে ট্র্যাকেই শুয়ে পড়লেন সুমি। ছবি: প্রথম আলো
>পাঁচ বছরে জাতীয় প্রতিযোগিতায় ২০টি সোনা জিতেছেন। পরশু শেষ হওয়া জাতীয় মিটে ৪টি সোনা ও একটি রুপা জিতে হয়েছেন সেরা নারী অ্যাথলেট।

জাতীয় অ্যাথলেটিকসে সবার চোখ থাকে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে। এই ইভেন্টে কে সেরা, সেটি নিয়েই যত আলোচনা। কিন্তু এর বাইরেও আছে অনেক ইভেন্ট। যেখানে এমন অ্যাথলেটের দেখা মেলে, যিনি নীরবে পদক–বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন। নাম সুমি আক্তার। এই সুমি চার বছর ধরে টানা নির্দিষ্ট কিছু ইভেন্টের পদক তুলছেন মনের আনন্দে। মাঝারিপাল্লার দৌড়বিদ হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন ঈর্ষণীয় এক জায়গায়।

জাতীয় মিটে ৪০০, ৮০০, ১৫০০ ও ৩ হাজার মিটার দৌড়ের শ্রেষ্ঠত্ব সুমির জন্যই যেন বরাদ্দ থাকে। গত শনিবার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে শেষ হওয়া ৪২তম জাতীয় অ্যাথলেটিকসও রাঙিয়েছেন এই অ্যাথলেট। চার সোনার সঙ্গে রিলেতে রুপা।
গত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ এবং সর্বশেষ ১৪তম সামার মিটেও মাঝারি দৌড়ে সুমি ওড়ান জয়ের পতাকা। মাঝখানে শুধু ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ৮০০ মিটারে হারেন নিজের দল সেনাবাহিনীর পাপিয়া খাতুনের কাছে। কিন্তু গত জুলাইয়ের সামার মিটেই সেটি পুনরুদ্ধার করেছেন।

গত বছর জাকার্তা ও পালেমবাং এশিয়ান গেমসে ৪০০ মিটার দৌড়েছেন সুমি। করেছেন নিজের সেরা টাইমিং (৫৭.১৬ সেকেন্ড)। নিজের হিটে হয়েছেন চতুর্থ। ৮০০ মিটারে হিটে পঞ্চম। জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ৪০০ মিটারের সেরা টাইমিংটা ধরে রাখতে পারেননি, কিন্তু কে হারাবে তাঁকে? ৪০০ মিটারে এবার সতীর্থ সাবিহা আল সোহাকে পেছনে রেখে জিতেছেন সোনা (৫৭.৪৬ সে.)। পাপিয়া খাতুনকে হারিয়ে ৮০০ মিটারে তাঁর টাইমিং ২:২৫.২০। ১৫০০ মিটারে ৫:১১.৯০। এই ইভেন্টেও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নিজ দলেরই পাপিয়া খাতুন (৫:১৪.১০)। ৩০০০ মিটারে টানা তৃতীয় সোনা জিতেছেন ১১:১২.২০ সময় নিয়ে। এসব টাইমিং এসএ গেমসের মানে অনেকটা দূরে। তাতে কী, সুমি দেশে তো সেরা।

বাংলাদেশের মেয়েরা শারীরিকভাবে দুর্বল। তাই দূরপাল্লার দৌড়ে সুবিধা করতে পারেন না। কিন্তু সুমি যেন একটু আলাদা। স্কুলে খেলতে খেলতেই জাতীয় স্তরে উঠে আসা। ‘সালাউদ্দিন স্যার’ তাঁকে জেলায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়ে যান। এরপর বিজেএমসি হয়ে সেনাবাহিনী। বিজেএমসির কোচ গোপাল সাহা সুমিকে দেখে বলেছিলেন, ‘তোমার শরীর মাঝারি দৌড়ের সঙ্গে যায়। কাজেই তুমি এই ইভেন্টটা করো।’ কোচ কথাটা বলেছিলেন, ২০১৪ সালে বিজেএমসিতে নতুন আসা সুমির জাতীয় মিটে ১০০, ২০০ মিটার স্প্রিন্ট দেখে। ১০০ মিটারে তখন তৃতীয় হয়েছেন সুমি। কিন্তু স্প্রিন্টে ভালো করা কঠিন মনে করেই কোচ তাঁকে নিয়ে আসেন মাঝারি দৌড়ে। ২০১৫ সালে সেনাবাহিনীর সৈনিক পদে এসেই শুরু মাঝারি দৌড়ে, তারপর একের পর এক পদক শিকার।

সেনাবাহিনী দলের কোচ সাবেক দ্রুততম মানব মাসুদুল করিম ছাত্রীকে নিয়ে মুগ্ধ, ‘মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় ওর আর আমার বাড়ি পাশাপাশি। ও আমাদের আর্মির গৌরব, রত্নও। ওকে ট্রেনিং করিয়ে অনেক মজা। যখন যা বলি, চোখ বন্ধ করে শুরু করে দেয়। প্রচুর পরিশ্রম করে। কারও সঙ্গে কথাও বলে না। এই দিনে এত ভদ্র মেয়ে পাওয়াই কঠিন।’

কৃষক বাবা আবদুল খালেক সুখী মেয়ের সাফল্য দেখে। দুই বোন, এক ভাইয়ের সংসারে এখন সুমিও আর্থিক সমর্থন দেন। খেলা নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন? ঝটপট উত্তর, ‘স্বপ্ন তো পূরণ হয়ে গেছে আমার।’ বলেন কী, এত তাড়াতাড়ি স্বপ্নপূরণ! সুমি বলতে থাকেন, ‘সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছি। সোনা জিতছি। এর চেয়ে আর বেশি কী চাওয়ার আছে! সামনে বিয়ে-শাদি হবে, ঘরসংসার করব। এই তো...।’ গ্রামের সহজ–সরল এক মেয়ের প্রতিচ্ছবি সুমি যে ট্র্যাকে অপ্রতিরোধ্য, অজেয়।