মা-ই তার দেখার চোখ

মায়ের চোখ দিয়েই খেলা দেখে নিকোলাস। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের চোখ দিয়েই খেলা দেখে নিকোলাস। ছবি: সংগৃহীত

রঙিন দুনিয়ার একটাই রং তার কাছে—কালো। ১২ বছর বয়সী নিকোলাস গ্রেচ্চো যে অন্ধ। ব্রাজিলের সাও পাওলোর ছেলেটি ভুগছে অটিজমেও। এত কিছুর পরও প্রিয় দল পালমেইরাস যখন খেলতে নামে, নিকোলাস ঠিকই হাজির স্টেডিয়ামে। অন্য সব দর্শকের সঙ্গে গোলের উদ্‌যাপনে লাফিয়ে ওঠে, গোল খেলে হয়ে পড়ে হতাশ, কখনো কখনো রেফারির সিদ্ধান্তে বিরক্তির প্রকাশও হয়তো চলে।

ফুটবলের আবেগের সঙ্গে নিকোলাসের অন্ধকার হয়ে থাকা দুনিয়ার যোগসূত্র? মা সিলভিয়া গ্রেচ্চো। অন্যদের মতো করে নিজ চোখে সবকিছু দেখার ভাগ্য তার কাছ থেকে প্রকৃতি কেড়ে নিতে পারে, নিকোলাস ফুটবলটা ‘দেখে’ মায়ের চোখেই। ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্ত মায়ের কণ্ঠের সৌজন্যেই মূর্ত হয়ে ওঠে নিকোলাসের কল্পনায়।

এমন ঘটনা রাশিয়া বিশ্বকাপের সময়ও চোখে পড়েছিল। পোল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে এক কলম্বিয়ান সমর্থক হাতের ইশারায় তাঁর শ্রবণপ্রতিবন্ধী বন্ধুকে ম্যাচে কী হচ্ছে, তা বোঝাচ্ছিলেন। সেটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাড়া ফেলেছে বেশ। কদিন আগে চ্যাম্পিয়নস লিগে নাপোলির বিপক্ষে লিভারপুলের ম্যাচেও একই দৃশ্য। মোহামেদ সালাহর গোলটা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী লিভারপুল সমর্থক বন্ধুকে বর্ণনা করে বোঝাচ্ছেন আরেক লিভারপুল সমর্থক, সেই দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ার পর দুজনকেই পরে ক্লাবের অনুশীলনে ডেকেছে লিভারপুল। একই সৌভাগ্য হয়েছে ইতালিয়ান ক্লাব রোমার এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারী সমর্থকেরও, যাঁর খেলা ‘দেখা’র মাধ্যম তাঁর বোন।

সিলভিয়া-নিকোলাসের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু হলো না। বরং গত বছর পালমেইরাসের কিছু ম্যাচে নিকোলাসকে সিলভিয়া যেভাবে ম্যাচের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করে শোনাচ্ছিলেন, সেটি টিভিতে দেখানোর পর নিজেদের এলাকায় বলতে গেলে সেলিব্রিটিই বনে গেছেন মা-ছেলে। ব্রাজিলের বেশ কয়েকটি টিভি অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে গেছেন দুজন, এমনকি পালমেইরাসের অনুশীলন সেশনেও যাওয়ার সুযোগ মিলেছে।

তা ম্যাচে কী কী বলেন ছেলেকে? কিছুদিন আগে পালমেইরাস-বোটাফোগো ম্যাচে ছেলেকে নিয়ে এসে মাঠে বসেই ৫৬ বছর বয়সী সিলভিয়া উত্তরটা দিচ্ছিলেন, ‘আমি সব খুঁটিনাটিই বলি ওকে। অমুক খেলোয়াড় ছোট হাতার জার্সি পরেছে, তাঁদের জুতোর রং কী, চুলের রং...।’ কিন্তু দেখে বোঝা, আর শুনে ম্যাচের আবেগে মিশে যাওয়া তো আর এক নয়। ছেলেকে কীভাবে আবেগটাও বোঝান, সে ব্যাখ্যা দিলেন সিলভিয়া, ‘আমার বর্ণনাটা হচ্ছে মূলত আমার অনুভূতিগুলোই বোঝানো। আমি তো আর পেশাদার নই। যা দেখি, যা অনুভব করি, ওকে বলি সেটা। এমনকি যখন রেফারিকে বকাঝকা করতে হয়, তখনো।’

নিকোলাসের পালমেইরাস সমর্থক বনে যাওয়ার গল্পও আবার আরেক চমক। যে গল্পে মিশে আছেন নেইমার! পরিবারে বাবা ও বোন অন্য ক্লাবের সমর্থক, কিন্তু নিকোলাসের মা পালমেইরাস পাঁড় ভক্ত। পারিবারিক ‘যুদ্ধে’র মুখে নিকোলাসকে পালমেইরাসের দিকে টানার দারুণ এক পরিকল্পনা এল মা সিলভিয়ার মাথায়।

নিকোলাস নেইমারের ভক্ত। এক অনুষ্ঠানে নেইমারের সঙ্গে নিকোলাসের দেখাও হয়েছিল। এরপর থেকেই পালমেইরাসের জার্সিটা নিকোলাসের প্রিয় হয়ে যাওয়ার গল্পটা জানালেন সিলভিয়া, ‘নেইমার ওকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। ও নেইমারের চুলে নিজের হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। অনেক অনেক বড় একটা মুহূর্ত ছিল সেটা! তখন আমি নেইমারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে ছোটবেলায় সে কোন ক্লাব সমর্থন করত। নেইমারের উত্তর ছিল—পালমেইরাস। ব্যস, আমি তখন নিকোলাসকে বললাম, “দেখেছ, তোমার মা, তোমার প্রিয় খেলোয়াড়—সবাই পালমেইরাসের ভক্ত। আমার মনে হয় তোমার দলও পালমেইরাসই হওয়া উচিত। ”’

প্রিয় দল বেছে দিয়েছিলেন, আর সে আবেগটাও ছেলের মনে গেঁথে দিতে চেষ্টার কোনো কমতি নেই সিলভিয়ার। নিশ্চিত, ফুটবল ছাপিয়ে জীবনের সব ক্ষেত্রেই অন্ধ ছেলের ‘যষ্টি’ তিনি। মা বলে কথা!