সব দায় নেইমারের?

বারবার কড়া ট্যাকলের শিকার হয়ে চোট পাচ্ছেন নেইমার। ছবি: এএফপি
বারবার কড়া ট্যাকলের শিকার হয়ে চোট পাচ্ছেন নেইমার। ছবি: এএফপি

মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় শুরু হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে চ্যাম্পিয়নস লিগের শুরু হচ্ছে শেষ ষোলোর ম্যাচ। লিগ মৌসুমেও শেষের দৌড়টা শুরু হবে এখন। ঘরোয়া লিগকে তো বহু আগেই একঘেয়ে বানিয়ে ফেলেছে প্যারিস সেন্ট জার্মেই। কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য তো ইউরোপ জয় করা। সে লক্ষ্যটা এবারও পূরণ হবে কি না সন্দেহ জাগছে। কারণ টানা দ্বিতীয়বারের মতো দ্বিতীয় পর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়কে পাচ্ছে না পিএসজি।

ফ্রেঞ্চ কাপে স্ট্রাসবুর্গের বিপক্ষে চোট পেয়ে মাঠ ছেড়েছেন নেইমার। পায়ের পঞ্চম মেটাটারসালে চোট পেয়েছেন নেইমার। এটা সেই হাড়, যে হাড়ে চোট পাওয়ায় গতবার রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে শেষ ষোলোর দ্বিতীয় লেগ খেলা হয়নি তাঁর। সেবার অস্ত্রোপচার করে মৌসুমের বাকি সময় বসে থাকতে হয়েছিল নেইমারকে। এবার অস্ত্রোপচার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নেইমার ও তাঁর ক্লাব। এতেও অবশ্য নেইমারকে শেষ ষোলোতে পাবে না পিএসজি। মরিনহোর বিদায়ের পর প্রাণ ফিরে পাওয়া ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে তাই এখন ফেবারিট ধরা হচ্ছে। লিগেও লিঁও ও মার্শেইয়ের বিপক্ষে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে থাকবেন না নেইমার। তবে লিগে ১৩ পয়েন্ট এগিয়ে থাকায় নিয়ে চিন্তা করছে না ক্লাব।

ফ্রেঞ্চ মিডিয়া অবশ্য এসব নিয়েও আলোচনা করছে না। সেখানে বিতর্ক চলছে এক বিষয় নিয়ে। এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নেইমারের অনুপস্থিতি কেমন প্রভাব ফেলবে, সে আলোচনার চেয়ে তাদের পাতে বেশি দাম পাচ্ছে এই আলোচনা—নেইমার মাঠে বেশি দক্ষতা দেখানোর চেষ্টা করেন বলেই এভাবে চোটে পড়ছেন কি না?

নেইমারের চোটে পড়ার পেছনে স্ট্রাসবুর্গের মিডফিল্ডার মোয়াতাজ জেমজেমির অবদান রয়েছে। আগেও কয়েকবার নেইমারকে ফাউল করেছিলেন জেমজেমি। তবে শেষবারের ধাক্কায় ডান পা বেকায়দায় পড়ে যায় নেইমারের। নিজের ভার সামলাতে পুরো ভর দিয়ে বসেন ডান পায়ের অ্যাঙ্কেলের ওপর। ম্যাচ শেষে স্ট্রাসবুর্গ কোচ তবু নিজের খেলোয়াড়ের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছেন, বলেছেন নেইমারেরও দায় আছে এভাবে ফাউলের শিকার হওয়ার পেছনে। মাঠে নিজের দক্ষতা দেখাতে গিয়ে নাকি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের অসম্মান করেন নেইমার!

স্ট্রাসবুর্গ কোচ থিয়েরি লরি বলেছেন, ‘আমার খেলোয়াড়দের মনে হতেই পারে তারা যথেষ্ট অপমানিত হয়েছে, আমিও ব্যাপারটা বুঝি। মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হলো কিন্তু তারও একটা সীমা থাকা উচিত। আপনি যখন পিঠ দিয়ে পাস দেবেন, এর মানে আপনি প্রতিপক্ষকে নিয়ে তামাশা করছেন। যখন আপনি সীমা অতিক্রম করবেন, তখন আপনাকে এর দায় নিতে হবে। আর দায় নেওয়া মানেই হলো, তাকে অন্যের লাথি সহ্য করতে হবে। আমি আমার খেলোয়াড়দের বলিনি লাথি (নেইমারকে) মারতে। কিন্তু কোনো একপর্যায়ে তারা ওর এমন খোঁচানোতে বিরক্ত যদি হয় সে অবস্থাটা আমি আঁচ করতে পারি।’

মাঠে স্কিলের প্রদর্শনী কমানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে নেইমারকে। ছবি: এএফপি
মাঠে স্কিলের প্রদর্শনী কমানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে নেইমারকে। ছবি: এএফপি

লরি স্ট্রাসবুর্গের ম্যাচের আগের সপ্তাহের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করছেন। এর আগের সপ্তাহেই গেঁগাকে ৯-০ ব্যবধানে হারিয়েছিল পিএসজি। সে ম্যাচে পিঠ দিয়ে পাস দিয়ে নিজের দক্ষতা দেখিয়েছেন নেইমার। স্ট্রাসবুর্গ ম্যাচেও মোয়াতেজ জেমজেমির সামনে দিয়ে রেইনবো ফ্লিক করে বল নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। নাটমেগ আর স্টেপওভার তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের এভাবে অপমানিত হতে কখনোই ভালো লাগে না। স্ট্রাসবুর্গের অ্যান্থনি গঞ্চালভেস ম্যাচ শেষে পরিষ্কার বলেছেন, ‘নেইমারের ধরনই এমন। কিন্তু আপনি যখন এভাবে খেলবেন, তখন প্রতিপক্ষের লাথি খেলে বিচার দিতে পারবেন না। আপনি নিজের খেলা উপভোগ করুন সমস্যা নেই কিন্তু পরে আবার কান্নাকাটি করতে পারেন না।’

বিতর্কটা নতুন কিছু নয়। লিগ ওয়ানে আসার পর থেকেই প্রতিপক্ষের কড়া ট্যাকলের নিয়মিত শিকার নেইমার। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড যেভাবে খেলেন, সেটা অনেকেরই ভালো লাগে না। তার অতিরিক্ত ড্রিবলিং ও নাটমেগে ডিফেন্ডাররা বেশ বিরক্ত হয়ে কড়া ফাউল করছেন তাঁকে। এ নিয়ে দুইবার রেফারিদের কাছে গিয়েছে পিএসজি, নেইমারকে যেন বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হয়। নেইমারকে ফাউল করা নিয়ে সাবেক দুই খেলোয়াড় ক্রিস্তফ ডুগারি ও জেরোম রোথেন রেডিওর সরাসরি সম্প্রচারে তর্কে জড়িয়েছিলেন।

ডুগারি বলেছিলেন, ‘নেইমার কেন এত জাহির করার চেষ্টা করে? পৃথিবীতে আর কোনো খেলোয়াড় এমন করে? না।’ সাবেক পিএসজি মিডফিল্ডার রোথেন আবার নেইমারের পক্ষে, ‘সে প্রতিপক্ষকে অপমান করে না। সে মাঠে যা করি তার সবই দরকারি। যখন আপনি ওর মতো প্রতিভাবান হবেন, তখন এটাই করবেন। নেইমারকে যখন অপমান করা হয় কিংবা লাথি মারা হইয়, তখন সে এভাবেই জবাব দেয়। এসব ট্রিক দেখায় আর সবাইকে দেখিয়ে দেয় টেকনিকের দিক থেকে সে সবার চেয়ে কত এগিয়ে। মানুষ কীভাবে বলে নেইমার তাঁর ট্রিক দিয়ে অন্যদের অসম্মান করছে?’

নেইমারের ফুটবল দর্শনই হলো মজার জন্য খেলা আর এভাবে দলকে সেরাটা দেওয়া। এসব ট্রিক করাকে জাহির করা নয় স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই ধরে নিন তিনি, যা অন্যরা করতে পারে না। কিন্তু এটা করতে চাওয়ার বিপদ আছে। সর্বকালের অন্যতম সেরা সৃষ্টিশীল খেলোয়াড়দের একজন হচ্ছেন জিনেদিন জিদান। তাঁর কথাতেই পরিষ্কার, কেন নেইমাত্রকে এভাবে ফাউল করা হয়, ‘তুমি যদি টানা দুই বা তিনবার করার পর আবার চতুর্থবার একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কাজ কর, তাহলে সে বলবেই যথেষ্ট হয়েছে এবং লাথি মারবে। এটাই হয়ে আসছে এবং আমি ভালোভাবেই এটা জানি।’

তার মানে ট্রিক দেখানোরও সীমা থাকা উচিত। নেইমারের প্রতিভা বিকাশ করুক এটা সবাই চায়, কিন্তু টানা দ্বিতীয়বারের মতো মৌসুমের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চোট পেয়েছেন নেইমার। সেটা নিজের দক্ষতা একটু বেশি দেখাতে গিয়েই। পিএসজি হয়তো আগামী মৌসুমে নেইমারকে বলতেও পারে, এসব কৌশল ক্লাবের অনুশীলনের জন্যই রাখতে। কারণ, নিজের ট্রিকারি দেখাতে গিয়ে যে বারবার চোট পাচ্ছেন নেইমার। পিএসজির চ্যাম্পিয়নস স্বপ্নটাও বারবার এভাবেই চোট পাচ্ছে। ইএসপিএন এফসির জুলিয়েন লরেন্সের লেখা অবলম্বনে।